বস্তিতে পুলিশের ঘরবাণিজ্য

রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে পুলিশ সদস্য আব্দুল মালেকের দোকান, পেছনে বাড়িও আছে- প্রতিবেদক
বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:০৩
রাজধানীর কড়াইলে সরকারি জায়গায় এক বস্তিতে ৬৪টি ঘর ও দোকানের মালিক বনানী থানার ওসির সাবেক গাড়িচালক কনস্টেবল গোলাম রহমান দিদারসহ তিন পুলিশ সদস্য। অপর দু'জন হলেন কনস্টেবল সামছুদ্দিন ও আব্দুল মালেক। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বস্তির মাস্তান ও স্থানীয় অসাধু রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাশাপাশি বস্তির বাড়ি কেনাবেচায় অংশ নেন তারা। কর্মসূত্রে কড়াইল বস্তি এলাকায় থাকার সুবাদে তারা ওই ঘর ও দোকান ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে লাখ টাকা কামাচ্ছেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, দীর্ঘ দিন বস্তির এই অবৈধ ঘরের মালিক ছিলেন অন্যরা। পুলিশ সদস্যরা নিজেদের প্রভাব ও পরিচয় ব্যবহার করে বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে এই ঘরগুলো কিনে নেন। বিক্রেতারাও দীর্ঘ দিন সেগুলো অবৈধভাবে দখলে রেখেছিলেন। কড়াইল বস্তি এলাকায় গুচ্ছ গুচ্ছ ঘরের সমন্বয়ে একটি 'বাড়ি' হয়ে ওঠে। এমন চারটি বাড়িতে পুলিশের তিন সদস্যের মালিকানায় পাকা, আধাপাকা ও টিনের ঘর রয়েছে। এর মধ্যে দুটি দোতলা বাড়ি।
বস্তির লোকজন বলছেন, সরকারি দায়িত্ব পালন করতে এসে পুলিশ সদস্যরা বস্তির ঘরবাণিজ্য করলে সমাজে ভুল বার্তা যায়। বস্তি ঘিরে নানা অবৈধ কারবারে জড়িতদের সঙ্গে পুলিশের অনৈতিক সখ্য গড়ে ওঠে। এতে সাধারণ হাজারো বস্তিবাসী বঞ্চনার শিকার হন।
সরেজমিন জানা যায়, মাদক কেনাবেচার অন্যতম স্থান কড়াইল বস্তি। নানা কৌশলে মাদকের হাতবদল হয় সেখানে। অবৈধ গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎও রয়েছে এ বস্তিতে। অথচ সেই অবৈধ কারবারের মধ্যেই বাড়ি কিনে ভাড়া দিচ্ছেন আইনের রক্ষক এই পুলিশ সদস্যরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গোলাম রহমান দিদার বর্তমানে গুলশান থানায় কর্মরত। তার দোতলা দুটি বাড়ি রয়েছে কড়াইলের বেলতলা ভাঙাওয়াল বস্তিতে। বনানী থানার বর্তমান গাড়িচালক কনস্টেবল সামছুদ্দিনের রয়েছে একটি বাড়ি। তিনি টিনের বাড়ি কিনলেও সেটি ভেঙে পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। তিনি কড়াইলে সামছু পুলিশ নামে পরিচিত। পুলিশের বিশেষ শাখার কনস্টেবল আব্দুল মালেকের রয়েছে একটি বাড়ি। তিনিও এক সময় বনানী এলাকায় দায়িত্বে ছিলেন।
বনানী থানার ওসি মো. নুরে আযম মিয়া সমকালকে বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য বস্তিতে ঘর কিনেছেন কিনা তা তার জানা নেই। যদি কেউ কিনে থাকেন সেটা পুলিশের বিধিবিধান-বহির্ভূত।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, প্রায় তিন বছর আগে কড়াইল বস্তিতে তৎকালীন স্টুডিও ব্যবসায়ী জনৈক রাজুর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকায় বেলতলা ভাঙাওয়াল বস্তিতে ২১টি ঘর ও ৪টি দোকান কেনেন পুলিশ কনস্টেবল দিদার। দিদার সে সময় বনানী থানার ওসির গাড়ি চালাতেন। বর্তমানে গুলশান থানায় কর্মরত। সম্প্রতি ঘর ভাড়া নেওয়ার কথা বলে সমকালের এই প্রতিবেদক দিদারের ওই বাড়িতে যান। এক নারী বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখান। দোতলাবিশিষ্ট বাড়িটির একাংশের নিচতলা ছাদের। নিচে মোট ঘর সংখ্যা ১০টি। দোতলা পাকা দেয়ালের ওপরে টিনের চারটি এবং সাতটি টিনের ঘর। ওই নারী জানালেন, পাকা ও আধাপাকা প্রতিটি ঘরের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। টিনের ঘরের ভাড়া আড়াই হাজার টাকা। বাড়িটি কার জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, 'বাড়ি কার সেটি জেনে আপনার কোনো লাভ নেই।'
জানা যায়, বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত হোমিও চিকিৎসক জনৈক মীর জাহিদুল হক। দিদারের দোকান ঘরেই তার হোমিও ফার্মেসি। মাঝেমধ্যেই সন্ধ্যার পর দিদার সেখানে যান বাড়ির খোঁজখবর নিতে। বস্তিতে দিদারের পাকা ও আধাপাকা দোতলা আরও একটি বাড়ি আছে। এটি কিনেছেন নিশি নামে এক নারীর কাছ থেকে। বেলতলা বস্তি থেকে বউবাজার বস্তির দিকে যেতে রাস্তা-সংলগ্ন বাম পাশে এর অবস্থান। নিচতলা পাকা। দোতলায় পাশে ইটের দেয়াল, ওপরে টিন। দোতলায় তিনটি ঘরই ভাড়া দেওয়া আছে। নিচতলায় তিনটি দোকান ঘর। ফার্মেসি. হলুদ-মরিচ ভাঙানোর কারখানা এবং অপরটি কামারের দোকান।
জানতে চাইলে কনস্টেবল দিদার সমকালকে বলেন, বাড়ি দুটি আমার না। বনানী থানায় চাকরির সূত্রে কড়াইল আমার চেনাজানা। বাড়ি দুটি আমার দুই বন্ধু উজ্জ্বল ও বিল্লাল কিনেছেন। কিন্তু সবাই জানে এটা আমার। তাই আমি নিজেও বলি বাড়ি আমার।
একবার বলছেন যে বাড়ি নিজের না, আরেকবার বলছেন নিজের- এমন প্রশ্নের জবাবে তার ভাষ্য- পুলিশের বাড়ি বললে বস্তিতে আমার বন্ধুদের ঝামেলায় পড়তে হবে না। ওরা মিরপুরে ব্যবসা করে।
অবশ্য একটি বাড়ির বিক্রেতা রাজু এ প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন যে তিনি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে পুলিশ কনস্টেবল দিদারের কাছে বাড়িটি বিক্রি করেছেন। মালিক হিসেবে দিদারের নামেই স্ট্যাম্প করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বাড়ি বিক্রেতা রাজু বর্তমানে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে থাকেন। বাড়ি বিক্রির পর তিনি গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তবে মাঝেমধ্যে আসেন কড়াইলে। পুলিশ ও প্রভাবশালীরা নানাভাবে হয়রানি করেছেন তাকে। পেন্ডিং মামলার আসামি করে বনানী থানার তৎকালীন এসআই আবু তাহের ভুইয়া গ্রেপ্তারও করেছিলেন রাজুকে। তাহের তখন কড়াইল বিট ইনচার্জ ছিলেন। বস্তিতে রাজুর বসবাসের বাড়ির রাস্তা বের করে দেওয়ার নামে তার কাছ থেকে এসআই তাহের অবৈধভাবে ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজুর সঙ্গে ফোনে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। সাংবাদিক পরিচয় জানার পর পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ভয়ে তিনি কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে বলেন, 'আপনি লিখলেই আপনার কাজ শেষ। আমাকে তো মাঝেমধ্যে কড়াইলে যেতে হয়। আমার বিপদ হতে পারে।' একপর্যায়ে রাজু আরও জানান, বেলতলা ভাঙাওয়াল বস্তি ও বউবাজার বস্তিতে তার কয়েকটি বাড়ি ছিল। দিদারের কাছে যেটি বিক্রি করেছেন, সেই দোতলা আধাপাকা বাড়িটি প্রায় ১১ বছর আগে তার কেনা। তিন বছর আগে ১৬ লাখ টাকায় তিনশ টাকার স্ট্যাম্প করে দিদারের কাছে বিক্রি করেন তিনি। এটি সরকারি জায়গা হওয়ায় রেজিস্ট্রি বা দলিল করার কোনো সুযোগ ছিল না। যে কারণে স্ট্যাম্পের ওপর ভিত্তি করেই বস্তির বাড়ি বা ঘর বেচাকেনা হয়। ওই বাড়ি সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করলে অন্তত ৩০ লাখ টাকায় তিনি বিক্রি করতে পারতেন। বাড়িটির পাশেই আরও একটি টিনের বাড়ি ছিল তার। সেখানে ঘর সংখ্যা ১৫টি। ভাড়াটেদের পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাসও করতেন সেখানে। এসব ঘরের বাসিন্দাদের বের হওয়ার রাস্তা দিদারের বাড়ির পূর্ব পাশে। দিদার বাড়িটি কেনার পরই পুলিশের সহায়তায় ওই রাস্তা বন্ধ করে দেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুনায়েদ ও তার সহযোগীরা। রাজুর অভিযোগ- রাস্তা বন্ধে সহায়তা করেছিলেন এসআই আবু তাহের। পরে রাস্তা বের করে দেওয়ার নামে তার কাছে আবু তাহের ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। রাজু রাস্তা পাওয়ার প্রত্যাশায় নগদ ২০ হাজার টাকা দেন আবু তাহেরকে। পরে আরও ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন তিনি। এই টাকা না দেওয়ায় রাস্তা আর পাননি রাজু। বাড়িটির দখল নিতে এসআই আবু তাহেরকে হাত করেন জুনায়েদ। আবু তাহের নানাভাবে হয়রানি করতে থাকেন রাজুকে, যাতে তিনি বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। শুধু তাই-ই নয়, রাজুকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হুমকিও দেওয়া হয়। একপর্যায়ে বাড়িটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন রাজু। বছর দুই-এক আগে দুই লাখ টাকায় ১৫টি ঘর জুনায়েদ নিজের নামে স্ট্যাম্প করে নেন রাজুর কাছ থেকে।
অভিযোগের বিষয়ে এসআই আবু তাহের ভুইয়া সমকালকে বলেন, প্রায় এক বছর আগে তিনি বনানী থানা থেকে পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি হয়েছেন। রাজু নামে তিনি কাউকে চেনেন না। রাস্তা বের করে দেওয়ার নামে কারোর কাছ থেকে তিনি টাকা নেননি। পেন্ডিং মামলায় গ্রেপ্তারের বিষয়ও তার মনে নেই। জুনায়েদকে তিনি চেনেন। তবে বাড়ি কেনায় জুনায়েদকে তিনি কোনো প্রকার সহায়তা করেননি বলে দাবি করেন। বলেন, 'এতদিন পর আমার বিরুদ্ধে সব মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।'
বউবাজার রোডে দুই পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি দুটি টিনের বাড়ির তথ্য বেরিয়ে আসে। একটি কনস্টেবল আব্দুল মালেকের এবং অপরটি কনস্টেবল সামছুদ্দিনের। বস্তিবাসী মালেক পুলিশ ও সামছু পুলিশের বাড়ি হিসেবেই চেনে ওই দুটি বাড়ি। ৪-৫ বছর আগে দুলাল নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে আব্দুল মালেক ১৬টি টিনের ঘর ও রাস্তা-সংলগ্ন দুটি দোকানঘর কেনেন চার লাখ টাকায়। প্রতিটি ঘর থেকে বর্তমানে মাসে ভাড়া তুলছেন দুই হাজার আটশ টাকা এবং দুটি দোকানের ভাড়া ১২ হাজার টাকা। মালেক যখন বাড়ি কেনেন তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি গোয়েন্দা ইউনিটে চাকরি করতেন। বর্তমানে তিনি পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত।
বাড়ি কেনার কথা স্বীকার করে কনস্টেবল আব্দুল মালেক সমকালকে বলেন, ৪-৫ বছর আগে বাড়িটি তিনি দুলাল নামে একজনের কাছ থেকে কিনেছেন। বস্তির ঘর ও রাস্তার পাশের দুটি দোকান ভাড়া দিয়েছেন। বাড়ি কেনা অনিয়মের কিছু নয় বলে দাবি করেন তিনি।
আব্দুল মালেকের পাশের বাড়িটি ছিল ইয়াছিন নামে এক ভাঙারি ব্যবসায়ীর। মাস দুই-এক আগে সাত লাখ টাকায় রাস্তা-সংলগ্ন একটি দোকান, ১৪টি ঘরসহ সাত লাখ টাকায় ক্রয় করেন কনস্টেবল সামছুদ্দিন। তিনি টিনের ঘর খুলে দোতলা পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। সামছুদ্দিন বনানী থানার গাড়িচালক।
কনস্টেবল সামছুদ্দিন বস্তিতে বাড়ি কেনার কথা স্বীকার করে সমকালকে বলেন, 'সবাই কেনে, আমিও কিনেছি। সরকার যখন বস্তি উচ্ছেদ করবে তখন আমারটাও উচ্ছেদ হবে। এতে সমস্যা কিসের।'
- বিষয় :
- রাজধানী
- পুলিশ
- বস্তি
- ঘরবাণিজ্য
- কড়াইল বস্তি