চিড়িয়াখানায় তিন মাসে ৮ প্রাণীর মৃত্যু, অব্যবস্থাপনা দেখে ক্ষুব্ধ মন্ত্রী

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ০৮:৪২ | আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ০৯:২৩
গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানানোর প্রচলিত কথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু রাজধানীর মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় গাধাকে ঘোড়া বানানো না হলেও, রাখা হয়েছে ঘোড়ার সঙ্গে। এক খাঁচায় ঘোড়ার সঙ্গে গাধা-এমন দৃশ্য দেখে অবাক হন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমও।
কারণ জিজ্ঞেস করতেই চিড়িয়াখানার কর্মকর্তরা বলেন, এখানে অনেক পশুপাখিই সমলিঙ্গের প্রাণীর অনুপস্থিতিতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছে। ফলে ঘোড়ার সঙ্গে গাধাকে রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এতে একাকিত্ব জীবনের অবসান হয়েছে। ভিন্ন প্রাণী হলেও তারা মিলেও গেছে। শুধু এ দুই প্রাণীই নয়, এখানে গন্ডারের সঙ্গে ভেড়াও রাখা হয়েছে।
সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি অ্যানথ্রাপ জীবাণুতে মারা যায় একটি সিংহী। প্রায় এক সপ্তাহ পর সমকালের অনুসন্ধানে বিষয়টি সামনে আসে। এরপর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তোড়জোড় শুরু হয়। চিড়িয়াখানায় কোনো অব্যবস্থাপনা কিংবা অবহেলা আছে কিনা- তা খোঁজার চেষ্টা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
সোমবার সকাল ৮টায় হঠাৎ জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করেন তিনি। কুয়াশাভেজা সকালে মন্ত্রীর এমন আকস্মিক পরিদর্শনে চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলেন। মন্ত্রীর আগমনের খবরে শুরু হয় তোড়জোড়। মন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমেই প্রথমে যান সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় মারা যাওয়া সিংহীর খাঁচার সামনে। সেখানে যারা দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেন মন্ত্রী।
প্রায় তিন ঘণ্টা তিনি সাংবাদিকদের নিয়ে পশুপাখির বিভিন্ন শেড ঘুরে দেখেন। এ সময় বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার চিত্র চোখে পড়ে। পশুপাখিদের খাবার বণ্টন কক্ষও ঘুরে দেখেন মন্ত্রী। সকাল ১০টার মধ্যে প্রাণীর খাবার পৌঁছানোর কথা থাকলেও ১১টার মধ্যেও আসেনি অধিকাংশ খাবার। এ সময় পশুপাখির খাবারের পরিমাণ ও মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শ ম রেজাউল করিম।
মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. মো. আব্দুল লতিফ খাবার সরবরাহকারী এক ঠিকাদারকে ফোনে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, 'অন্যান্য দিন সকাল ১০টার মধ্যে খাবার এলেও আজ ১১টার পরও আসেনি কেন? আপনাদের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।' এ বিষয়ে তিনি সমকালকে বলেন, 'খাবার কখনও দেরি হয় না। আজ মন্ত্রী এসেছেন, আজই দেরি হলো। এটা দুর্ভাগ্য।'
প্রতিদিন বিকেল থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত চিড়িয়াখানায় কোনো চিকিৎসক না থাকায় মন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চিড়িয়াখানার পশু হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নজরে আসে মন্ত্রীর। হাসপাতালে ওষুধ, ভ্যাকসিন কিংবা টিকা সংগ্রহ ও প্রয়োগের আপডেট কোনো তথ্যও নেই। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রী। এ বিষয়ে ওই হাসপাতালের দায়িত্বরতরাও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ঘটনায় মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর পরিচালক মো. আব্দুল লতিফ কর্মকর্তাদের সতর্ক করেন।
পশু জবাই খানার বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও পরিবেশবান্ধব নয়। বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি চলে যায় চিড়িয়াখানার লেকে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিবেশবান্ধব করার নির্দেশ দেন মন্ত্রী। তিনি মৃত প্রাণীগুলোর খাঁচাসহ অন্যান্য প্রাণীর খাঁচা ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং খোঁজখবর নেন। যেসব প্রাণী মারা গেছে এবং অসুস্থ অবস্থায় আছে, সেগুলোকে কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, সেসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান তিনি। এ ছাড়া চিড়িয়াখানার বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকা, ময়লা-আবর্জনা ও কর্মকর্তাদের দেরিতে উপস্থিতির বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মন্ত্রী।
চিড়িয়াখানায় বিকেল ৩টার পর সকাল ৭টা পর্যন্ত প্রাণীগুলোর শেডে আনসার ছাড়া কেউ দায়িত্ব পালন করে না কেন- প্রশ্ন রেখে মন্ত্রী বলেন, এখানে আরও দায়িত্বশীলতা দরকার।
পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, সম্প্রতি জাতীয় চিড়িয়াখানায় দুটি বাঘ শাবক, জেব্রা, দুইটি জিরাফ শাবক, আফ্রিকান সিংহ, ইম্পালা ও ওয়াইল্ড বিস্ট মারা গেছে। ব্যাকটেরিয়ার কারণে এসব প্রাণী মারা গেছে বলে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে মনে করা হচ্ছে। দেশের সব চিড়িয়াখানায় বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যাতে কোনো জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে।
চিড়িয়াখানায় অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, যে ধরনের খাবার দেওয়া হচ্ছে, অতীতের চেয়ে সতর্ক হয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুষ্টিসম্মত ও জীবাণুমুক্ত খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা- এ জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া গতানুগতিকভাবে এখানে যাতে আর কোনো খাবার না আসে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রাণী মৃত্যুর ঘটনায় কারও অবহেলা থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রাণী মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে দুটি কমিটি গঠনের পর আরও একটি কমিটি করা হচ্ছে। দুবাই, সিঙ্গাপুরের আদলে চিড়িয়াখানা গড়ে তুলতে সরকার কাজ করছে বলেও জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া মার্চের মধ্যে হতে পারে। রংপুর ও ঢাকা চিড়িয়াখানায় অস্থায়ীভাবে জনবল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এসব বিষয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. আবদুল লতিফ সমকালকে বলেন, আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। জনবল সংকট রয়েছে। তারপরও সাধ্যমতো চেষ্টা করছি প্রাণীগুলোকে সুস্থ রাখার।