ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ডন দিয়েগো ম্যারাডোনা

ডন দিয়েগো ম্যারাডোনা

হাসান নিটোল

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ০৯:৩৯ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ১০:৪৮

'এবার আর ঈশ্বরের হাতের প্রয়োজন নেই। কারণ ঈশ্বর নিজেই চান এবার আমরা বিশ্বকাপ জিতি'- ২০১০ বিশ্বকাপে চিরশত্রু জার্মানির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের আগে এভাবেই ঈশ্বরের অভিপ্রায়ের কথা দুনিয়ার ভক্তদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। সে মোতাবেক দিয়েগোভক্তরাও বসে ছিল টিভি সেটের সামনে। কিন্তু দিয়েগোর সঙ্গে যে সেবার ঈশ্বরের যোগাযোগটা সঠিকভাবে হয়নি, তা বুঝতে ভক্ত-পাগলদের পুরো খেলা দেখতে হয়নি। খেলার ৬৫ মিনিটের মধ্যেই চার চারটি গোল হজম করে সেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। হতাশ ভক্তরা ম্যারাডোনাকে 'পাগল' বলে গালি দিতে দিতে বাড়ির পথ ধরেছে। ম্যারাডোনার কথায় আস্থা রেখে তাদের ডুবতে হয়েছে। শুধু যে এবার ডুবেছে, তা তো নয়। বারবার হেরেছে, বারবার ডুবেছে। নাহ, আর সাপোর্ট করা যায় না; যথেষ্ট হয়েছে।\হকিন্তু একবার তো ঈশ্বরের সঙ্গে দিয়েগোর যোগাযোগ হয়েছিল ঠিকঠাক। সেটা ঠিক তার দুই যুগ আগে; ১৯৮৬ বিশ্বকাপে। সেবার বিতর্কিত 'ঈশ্বরের হাত' দিয়ে একটা গোলও করেছিলেন ম্যারাডোনা। রেফারি সেটি ধরতে পারেননি। সেবারই বিশ্বকাপ জিতে যায় ম্যারাডোনা। এ নিয়ে কত আলাপ! দিয়েগো বলেছিলেন, 'ইট ওয়াজ দ্য হ্যান্ড অব গড।' বলেছিলেন, 'ব্রিটিশরা ফকল্যান্ড যুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষের মনে যে কষ্ট দিয়েছিল, আমি সেটাই ফেরত দিতে চেয়েছিলাম।; নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত মানুষেরা তার কথা বিশ্বাস করে; তার পক্ষ নেয়। অন্যদিকে, হেরে যাওয়া দল ইংল্যান্ডের ক্ষুব্ধ কোচ ববি রবসন বলেছিলেন, 'ইট ওয়াজ নট দ্য হ্যান্ড অব গড। 

ইট ওয়াজ দ্য হ্যান্ড অব এ রাসকেল।' নিপীড়িত মানুষ ইংলিশ কোচের কথা সেবার থোড়ায় কেয়ার করে। কারণ, ঈশ্বরের হাত মানে ব্রিটিশদের পরাজিত করা। ব্রিটিশ উপনিবেশ, ব্রিটিশ শাসন- এই সবকিছু। সাম্রাজ্যবাদে সবকিছুর বিরুদ্ধে অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে এই হাত। অনিয়মের পূজারি দুষ্টু ম্যারাডোনা তাই অট্টহাসি হেসে বলেন, 'আমি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আরও একটি গোল করার স্বপ্ন দেখি। আর সেটা ডান হাতে।' তাই তার ভক্তরা বলে, 'ও আমাদের সোনার ছেলে। ওই পারবে সাদাদের ঘাড়টা মটকে দিতে।' পরের বিশ্বকাপ। ঈশ্বরের ম্যারাডোনায় আস্থা রেখে ভক্তরা টিভি সেটের সামনে বসে ১৯৯০ সালে। কিন্তু সেবার ম্যারাডোনার কথা ঈশ্বর শোনেননি। বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে চিরশত্রু জার্মানির কাছে হেরে যান ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনা অঝোরে কাঁদেন। আর কাঁদে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ। এত কান্না! লেখক মিলন পাঠান সেই মুহূর্তকে তুলে ধরেন এভাবে, 'নায়কের চোখে জল। আমাদের শুধু চোখে নয়; আকাশেও জল ছিল সেদিন।; এই হারের জন্য ম্যারাডোনা দায়ী করেন ফিফাকে। বলেন, ফিফার রেফারি ষড়যন্ত্র করে তার দলকে হারিয়ে দিয়েছেন। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে। সঙ্গে বিশ্বাস করে বাদবাকি নিপীড়িত বিশ্ব। আর দিয়েগো-ভক্তরা আরেক কাঠি সরেস। বেশি দায়ী করে ফিফাকে; ফিফার বিরুদ্ধে মিছিল করে।

শুধু যে বাংলায়ই এমন কাণ্ড হয়েছে, তা নয়। দিয়েগো যখন ইতালির নেপোলিতে খেলেন, নেপলসবাসী তাদের ঘরে যিশুখ্রিষ্টের ছবির পাশে ওর ছবি টানিয়ে রাখে। ভক্তরা বলে, দিয়েগো 'ফুটবল ঈশ্বর'।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে সেই ভক্তদের হৃদয় ভেঙে দেন ম্যারাডোনা। ভক্তদের চোখে জল। ফিফা তাকে নিষিদ্ধ করে। ১৯৯৬ সালে আবারও ডোপ টেস্ট। আবারও পজিটিভ। এবার সদম্ভে তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন- 'আই ওয়াজ, আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল অলওয়েজ বি অ্যান অ্যাডিক্ট।' নিষিদ্ধ নেশা নিয়ে দুনিয়ায় আর কোনো তারকা এমন বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন বলে ভদ্র সমাজ জানে না। ম্যারাডোনা-ভক্তরা অবাক। তাদের হৃদয় ভেঙে কান্না আসে। ভক্তদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, 'আমি ম্যারাডোনা। আমি ভুল করি, আমি গোলও করি। আমি এসবই বয়ে বেড়াতে পারি। সবার সঙ্গে লড়াই করার মতো যথেষ্ট চওড়া কাঁধ আমার আছে।' ভক্তরা আবার চাঙা হয়। বলে, ওই পারবে। রাত গভীর হয়। আবার বিশ্বকাপ আসে। আবারও খেলতে আসে তার দল। আবারা হারে তার দল। তিনি কাঁদেন। অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে তার ভক্তরা। খেলার আসর ভেঙে যায়। মানুষ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যায়। রাত আরও গভীর হয়। পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে। ম্যারাডোনা মরে যায়। এবার আবার। ভক্তদের স্বপ্নে আসেন ম্যারাডোনা। ঠাকুরমার ঝুলির ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসে গল্প; কল্পকাহিনি। জানো দাদু ভাই... এক দেশে এক খেলোয়াড় ছিল, তার নাম ম্যারাডোনা। সেই গল্পে তিনি কোন দেশের, তিনি কী খেলেন, সেগুলো বড় বিষয় নয়। বিষয় হলো, তিনি ম্যারাডোনা, তিনি জাদুকর।

রংপুরের কৃষক রফিক মিয়া নিজের জরুরি কাজ ফেলে অনেক আশা নিয়ে গিয়েছিলেন খেলা দেখতে। চার গোল খেয়ে হেরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমুতে গেলেন। জীবনের মতো কসম কেটে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন রফিক- আর কখনা ম্যারাডোনার দলকে সাপোর্ট করবেন না। রাত শেষে ভোর হয়। নতুন আলোর দেখা পায় পৃথিবী। রফিকের ঘুম ভাঙে এক কান্নার শব্দে। বাড়ির সবাই সেই কান্নার শব্দ শুনে ছুটে যায়। ঘরে নতুন শিশু এসেছে। রফিকের শিশু। কী নাম হবে তার? সবাই মিলে নাম রাখল- কামাল। আনন্দে আত্মহারা হয় রফিক। সে আনন্দ ছড়িয়ে যায় দিল্লিতে। একই আনন্দ। আগত নতুন শিশুর নাম রাখা হয় গৌতম। ইরাক থেকেও আসে নতুন কান্না। নাম রাখা হয়- হাসান। ইউরোপের পাড়ায় পাড়ায় কান্না, নাম রাখা হয় রিচার্ড, নাম হয় ডেভিড। সান্তিয়াগোতেও তাই, কারলোসের জন্ম হয়। নতুন শিশুদের কান্না শুনে আনন্দে আত্মহারা হয় বিশ্ব। রফিক গভীরভাবে তার শিশুর মুখের দিকে তাকায় আর ভাবে, ওর নাম তো কামাল নয়; ওর নাম হলো ম্যারাডোনা। এই তো আমার ম্যারাডোনা। ঈশ্বর পৃথিবীতে নতুন 'ডন দিয়েগো ম্যারাডোনা' পাঠায়। জীবনানন্দ কহেন দীর্ঘশ্বাসে, 'কি বা, হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।'

আরও পড়ুন

×