ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া

ড. নিয়াজ আহম্মেদ

প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ০৪:৫৭ | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ০৪:৫৯

নারী জাগরণে অনন্য অবদান রেখে গেছেন আমাদের পথিকৃৎ ও অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। তৎকালীন সময়ে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও অন্য নারীদের মতো তাকেও রক্ষণশীল সমাজের আদলে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি জীবনযাপন করতে হতো। সেখানে ধর্মীয় কুসংস্কার, ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক সব নিয়মকানুন প্রচলিত ছিল। এমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন বেগম রোকেয়া। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু- এই তিনটি ভাষায় তিনি অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন। তার ভাইয়ের কাছ থেকে তিনি যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা ও সাহস পেতেন। স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ফলে মুসলিম নারীদের দুঃখ-দুর্দশা খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য তার হয়েছিল। ১০ বছরের সংসারজীবনে দুটো কন্যাসন্তান জন্মদান এবং তাদের অকালে মৃত্যু তাকে এতটুকুও দমাতে পারেনি। এ সময়ে তিনি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিলেন তার স্বামীর কাছ থেকে। 

শুধু শোক কাটানোই নয়, সাহিত্যচর্চা ও শিক্ষা বিস্তারে বেগম রোকেয়ার চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনায় সর্বদা স্বামী সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন তার পাথেয়। প্রথম জীবনে বেগম রোকেয়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখতেন, যা তৎকালীন সময়ের কবি-লেখকদের নজর কাড়ে। এমন কতগুলো লেখা নিয়ে তার সংকলন প্রকাশিত হয়। তার লেখা 'মতিচুর' ও 'অবরোধবাসিনী' নারীদের দুঃখ-দুর্দশারই প্রতিফলন। তার লেখা আজকে আমাদের পথ দেখাতে সাহায্য করে আসছে। তিনি এত কাছ থেকে সবকিছু অবলোকন করেছেন, পরবর্তী সময়ে তার চেষ্টা সাহিত্যকর্মের বাইরে গিয়ে শিক্ষা ও সমাজসেবায় পরিণতি লাভ করে।

বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সে এবং ২৮ বছর বয়সে তার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী নিয়ে ভাগলপুরে সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় তাকে। অতঃপর তিনি স্কুলটিকে কলকাতায় স্থানান্তর করেন। কলকাতায় এসে তার শিক্ষার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় ৮-এ। তখনকার সময়ে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষা ছিল না বললেই চলে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ অনেকে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও সেখানে মুসলিম মেয়েরা পড়াশোনা করতে যেত না। মোট কথা মেয়েদের অভিভাবকদের নারীশিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। 

ফলে বেগম রোকেয়াকে একদিকে শিক্ষার্থী সংগ্রহের জন্য অভিভাবকদের বোঝাতে হতো, অন্যদিকে স্কুলের ব্যয় নির্বাহের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হতো। অবশ্য তিনি এক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন। শিক্ষক বলতে বেগম রোকেয়া একা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারে যে অবদান এবং চিন্তাভাবনা আমাদের সমাজে রেখে গেছেন, যা আধুনিক জীবনে আমাদের পাথেয় হিসেবে কাজ করছে। তিনি আমাদের শিক্ষার প্রেরণার উৎস হিসেবে শত শত বছর স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

সমাজসেবায় তার অবদান আমরা চিরকাল স্মরণ করব। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯১৬ সালে তিনি 'আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম' নামে এক মহিলা সমিতি গঠন করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাঙালি মুসলিম নারীদের সামাজিক গোঁড়ামি আর ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজাল ভেঙে বের করে আনা। কীভাবে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনা যায় এবং অন্যকে সাহায্য করা যায়। এ জন্য প্রয়োজন সভা-সমিতি। তিনি তা করতে সক্ষম হলেন। বেগম রোকেয়া হলেন সমিতির সেক্রেটারি। অনেক কষ্ট করে তিনি মহিলাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও তাদের সদস্য হওয়ার জন্য উৎসাহিত করলেন। এ কাজ কোনোক্রমেই সহজ ছিল না। ১৯১৭ সালে সমিতির প্রথম বর্ষপূর্তিতে এসে এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়াল ৫০-এ। সমিতির মূল উদ্দেশ্য ছিল, নারীদের স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল করা। সভায় নারী আন্দোলন, শিশু মঙ্গল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। কলকাতার বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সে জন্য বস্তিতে স্কুল খুলে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন তিনি। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ধর্ম শিক্ষা, শিশু পালন ইত্যাদিও শিক্ষা দিতে লাগলেন। আত্মনির্ভরশীল করার জন্য শেখানো হতো সেলাই ও হাতের কাজ। গরিব ও দুর্বলদের হাত পরিণত হলো কর্মীর হাতে। দরিদ্র কুমারী কন্যাদের বিয়ের জন্য আর্থিক সাহায্য, বিধবা নারীদের জীবিকার ব্যবস্থা সব কাজেই এগিয়ে এলো এই সমিতি। কলকাতায় তিনি একটি মহিলা ট্রেনিং স্কুল খোলার জন্য সরকারকে অনুরোধ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১৯ সালে প্রথম মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করা হয়।

বেগম রোকেয়া আমাদের যে পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন, তা আমাদের পাথেয় হিসেবে কাজ করছে। আজকের নারীরা শিক্ষা-চাকরি সব ক্ষেত্রে সফল। রক্ষণশীলতার বেড়াজাল ভেঙে শত বাধা সত্ত্বেও নারীরা আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের মেধা ও মননের মাধ্যমে সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। আজ তার জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং স্মরণ করছি পরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া অসংখ্য নারী, যারা নারীদের নিয়ে কাজ করে সফল হয়েছেন। আমার মা একজন জয়িতা। আমাদের দেশের অসংখ্য জয়িতা রয়েছেন যাদের সমর্থন, সহযোগিতা ও শত বাধা পেরিয়ে বিশেষ করে নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থান আলো ছড়াচ্ছে। তাদের সবার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, সালাম ও অভিনন্দন। যে স্বপ্ন বেগম রোকেয়া দেখতেন তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। আশা করি, আমরা সবাই মিলে তা করতে পারব।

আরও পড়ুন

×