আলোর পথে প্রত্যাবর্তন

ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:৩৬ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২১ | ০৪:৫৮
১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধু নিজে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে 'অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ আলোর পথের দিশারি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরেন। এদিন বাঙালি তাদের ইতিহাসের বরপুত্রকে স্বাগত জানায়। বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে আনন্দ-অশ্রুতে বুকে আলিঙ্গন করে বরণ করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য অনুযায়ী 'অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা'-কে আমরা একটু বিশ্নেষণ করলে তার মন্তব্যের যথার্থতা অনুধাবন করতে পারি। ব্রিটিশ শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি অনেক স্বপ্ন আশা নিয়ে পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল। কিন্তু সে আশা ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্তি সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্ররোচনায় অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতাদের সমর্থনে ভারত বিভক্তি সংক্রান্ত লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বাংলা প্রদেশের অধিবাসী হয়েও খাজা নাজিমুদ্দিন এবং মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সেদিন জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। ভূখণ্ডগত সংযোগ না থাকলেও শুধু ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়, যা ছিল কনফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাসে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল পূর্ববঙ্গের নাম দেওয়া হয় 'পূর্ব পাকিস্তান', যা মুখ্যত ছিল পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কখনোই ন্যায়ভিত্তিক আচরণ করেনি। তারা অব্যাহতভাবে পূর্ব পাকিস্তানে অনাচার ও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। এর শুরুটা করে রাষ্ট্রভাষা দিয়ে। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তান একেবারেই অগ্রহণযোগ্য অবস্থান গ্রহণ করে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯৮ দশমিক ১৬ ভাগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ০ দশমিক ০২ ভাগসহ সর্বমোট ৫৬ দশমিক ৪০ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ০ দশমিক ৬৮ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৭ দশমিক ০৫ সর্বমোট ৩ দশমিক ৩৭ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু। অথচ ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশনে এবং পল্টনের জনসভায় পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার কথা জানান। মূলত ভাষা আন্দোলন দিয়েই বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার সংকল্প করে, যা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশরা থাকতেই। ১৯৪৭ সালের ১৮ মে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে এবং ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ কর্তৃক উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা প্রস্তাব করা হয়। ভাষা যে-কোনো জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অবিচ্ছ্যেদ অংশ। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক-গোষ্ঠীর এ সংস্কৃতিকে অস্বীকার এবং অসম্মান করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শুধু উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি আন্দোলন শুরু করে।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক কৃষি, সমবায় ও পল্লি উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রথম সারির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ঘটনা পরস্পরায় বঙ্গবন্ধু সবাইকে ছাড়িয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ে প্রধান নেতা হিসেবে জনমনে স্থান লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাঙালি স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হলে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পনাপ্রসূত বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা 'অপারেশন সার্চলাইট' বাস্তবায়নের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। এর পরই পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে তার ৩২ নম্বরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে আটকে রাখে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ৯ মাস ১৪ দিন কারাভোগ করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে তার নামে।
১৯৭১ সালের অক্টোবরে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ হয়। একদিকে বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে প্রহর গুনছিলেন। তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দুঃখবোধ আছে এ জন্য যে, তিনি বঙ্গন্ধুর ফাঁসির আদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। পাকিস্তানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খানকে অপসারণ করে ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে আবেদন করেছিলেন- 'আমার একটি স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেটি হলো শেখ মুজিবকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো, আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হোক।' এ কারণে ভুট্টো মিয়ানওয়ালি কারাগারের জেল সুপার হাবীব আলীর কাছে বার্তা পাঠান এবং বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালি কারাগার থেকে চশমা ব্যারাকে হাবীব আলীর বাসভবনে নিয়ে রাখা হয়। এরপর ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুনয়-বিনয় করে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক রাখার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ভুট্টো ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন এবং পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে তিনি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। পরদিন ৯ জানুয়ারি লন্ডনে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু একটি বিবৃতি দেন।
'জয় বাংলা' রণধ্বনি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, 'বাংলার মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেলে বন্দি জীবন কাটাচ্ছিলাম। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে ধন্যবাদ জানান। এ সময় তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশকে অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্যপদ দেওয়ারও দাবি জানান। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ফিরতে মরিয়া বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নন। তিনি অবিলম্বে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ফিরে আসার ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন। বিবৃতির পর সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, 'আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ?' তখন জাতির পিতা বলেছিলেন, 'আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব।'
জাতির পিতার দুটি স্বপ্নের মধ্যে ছিল- বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। প্রথম স্বপ্নটি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করেছিলেন। বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা তিনি এনে দিয়েছেন। অন্য স্বপ্নটি যখন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে তাকে হত্যা করা হয়। জাতির পিতাকে হারানোর দুঃখের মধ্যে '৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাস জীবন কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে জাতির পিতার দ্বিতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতায় উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অনেক দেশকে টপকে যাচ্ছে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিটির সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আজ দৃশ্যমান। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন, 'সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে।' অমর্ত্য সেনের পর্যবেক্ষণমূলক এ মন্তব্য বাংলাদেশ অর্জন করেই থেমে থাকেনি; সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি, রিজার্ভ, রেমিট্যান্স এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বেশি। সামাজিক খাতে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ও জন্মহার ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে কম। নারীর ক্ষমতায়নেও শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়; বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে। এর সবটাই অর্জিত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের স্থিতিশীলতার কারণে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের 'সোনার বাংলা' এখন অধরা নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা দৃশ্যমান। জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আনন্দ ও গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রেষণে কোষাধ্যক্ষ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা।