বিদ্যাদেবী সরস্বতী

ফাইল ছবি
ড. কানাই লাল রায়
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ১২:০১
বিদ্যা ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। আবহমানকাল এই দেবী বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরূপে পূজিত হয়ে এসেছেন। গ্রিক দেবী এথেনির সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য অনেকে কল্পনা করে থাকেন। রোমান দেবী মিনার্ভার সঙ্গেও দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য কল্পিত হয়ে থাকে। দেবী মিনার্ভার সঙ্গে গ্রিক দেবী এথেনি একীভূত হয়ে গেছেন। তিনি সকল বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিদ্যায়তনের অধিকারিণী। এথেনিয়াম শব্দের অর্থ বিদ্যামন্দির বা গ্রন্থাগার, বিদ্যাদেবী এথেনির নাম থেকেই সম্ভবত এথেনিয়াম শব্দের উৎপত্তি। আইরিশ দেবী ব্রিজিদ কাব্য, শিল্প ও আরোগ্যের দেবতা হিসেবে পূজিত। এর সঙ্গেও দেবী সরস্বতীর সাদৃশ্য কল্পনা করা হয়। তবে জাপানে পূজিত সমুদ্রদেবী বেনতেন যেন দেবী সরস্বতীর প্রতিমূর্তি। ইনি অষ্টভুজা, এর দুই হাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে যুক্ত। বীণা নামক বাদ্যযন্ত্র তার প্রিয়। তাকে চিত্রে সমুদ্রগর্ভে পদ্মোপরি উপবিষ্টা অথবা বীণা বাদনরত অবস্থায় দেখা যায়। বেনতেন যেন লক্ষ্মী, সরস্বতী ও সর্পের মিশ্রিত রূপ। তবে যবদ্বীপে প্রাপ্ত পদ্মাসন বীণাহস্ত বীণাবাদনরত সরস্বতী মূর্তি ও তিব্বতে বজ্রধারিণী ময়ূরবাহনা বজ্রসরস্বতী মূর্তি নিঃসন্দেহে আমাদের বিদ্যাদেবী সরস্বতী।
প্রাচীনতম বেদ ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১২৫ সূক্তে দেবী সরস্বতী বাগদেবী রূপে উল্লিখিত হয়েছেন। এই বাগ্দেবী মানুষের হৃদয়কে নির্মল ও পবিত্র করেন। তিনি অন্নদাত্রী, সুন্দর ও সত্যবাক্যের প্রেরণকর্ত্রী, সুবুদ্ধির উদ্বোধনকারিণী, যজ্ঞের ধারণকর্ত্রী। মহাসমুদ্রের মতো অসীম পরমাত্মাকে চিহ্নের দ্বারা প্রকাশ করেন সমস্ত নরনারীর হৃদয়ে জ্যোতি সঞ্চারিত করেন। কাজেই ঋগ্বেদে তিনি ঠিক বিদ্যার দেবী নন। তিনি শক্তিরূপিণী। কিন্তু অথর্ববেদে সরস্বতীই বাগ্দেবী। রামায়ণে, মহাভারতে বাগ্দেবী স্পষ্টই বিদ্যাদেবী সরস্বতী। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ইনি পঞ্চ প্রকৃতির অন্যতম এবং পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী। কোনো কোনো পুরাণে তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্রী ও স্ত্রীরূপে উল্লিখিত হয়েছেন। আবার কোনো কোনো পুরাণে তিনি গণদেবতা গণেশের স্ত্রীরূপেও বর্ণিত হয়েছেন। চণ্ডীতে এই দেবী বাগীশ্বরী, বীণাপাণি, বাগ্-বাদিনী, সরস্বতী, ভারতী, বাণী, সারদা, মহাশ্বেতা, মহাবিদ্যা, মহালক্ষ্মী প্রভৃতি বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছেন। শাস্ত্রে আছে, তিনি সংস্কৃত ভাষা ও দেবনগরী লিপি এবং কাব্যপুরুষের জন্মদাত্রী। সরস্বতী শব্দের অর্থ সরস্ (জল)+বতী অর্থাৎ জলবতী বা নদী। সরস্বতী প্রাচীন আর্যভূমি সপ্তসিন্ধুর অন্যতম নদী। সরস্বতী নদীশ্রেষ্ঠ, দেবীশ্রেষ্ঠ, জননীশ্রেষ্ঠ (নদীতমে, দেবীতমে, অম্বিতমে)। নদী সরস্বতী যে বৈদিক যুগেই প্রসিদ্ধ ছিল তা নয়, পরবর্তীকালে মহাভারতে, পুরাণে, কাব্যে সরস্বতী পূতসলিলা নদীরূপে কীর্তিত হয়েছেন। ঋষিরা সরস্বতী নদীতীরে বেদ অধ্যয়ন ও বেদচর্চা করতেন, কালক্রমে নদী সরস্বতীই বিদ্যাদেবী সরস্বতীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন।
তান্ত্রিক সাধকরা নীলবর্ণা সরস্বতীর অর্চনা করে থাকেন। সেখানে এই দেবী কৃষ্ণা নামে অভিহিত। অন্যত্র যে নীলবরণ সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়, তদানুসারে তিনি শববাহনা চতুর্ভুজা এবং ত্রিনয়নী। চার হাতে তার খড়্গ নরমুণ্ড অসি ও নীলোৎপল। তিনি সম্পদ, শ্রী ও সৌভাগ্যদায়িনী। কোনো কোনো স্থানে তিনি দশ মহাবিদ্যার অন্যতম রূপেও বর্ণিত হয়েছেন। সেখানে তার রূপ অতি ভীষণা। কোনো কোনো গ্রন্থে অষ্টভুজা সরস্বতীর উল্লেখ আছে। এই অষ্টভুজা সরস্বতী শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক মহাদানবদ্বয়কে সংহার করেছিলেন। তার আট হাতে ছিল বাণ, শূল, মুষল, চক্র প্রভৃতি আটটি প্রহরণ। শাস্ত্রে আছে, এই দেবীর আরাধনায় সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গম হওয়া যায়। অন্যত্র দেবী সরস্বতী আবার মহাকালী রূপেও বর্ণিত হয়েছেন। তিনি শবারূঢ়া এবং খড়্গ, মালা, অঙ্কুশ ও পুস্তকধারিণী। এই দেবীর আরাধনায় ধর্মশাস্ত্রাদিতে ব্যুৎপত্তি লাভ হয়।
শুধু হিন্দু ধর্মেই নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মেও দেবী সরস্বতীর পূজার প্রচলন আছে। বৌদ্ধ মহাযান গ্রন্থগুলোতে জাঙ্গুলিতারা, সিততারা ও বজ্রতারা নামে তিনজন দেবী আছেন, তারা সরস্বতীর অনুরূপ। বৌদ্ধ সাধনমালাতে মহাসরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী, বজ্রসারদা ও আর্যসরস্বতী- এই চার প্রকার সরস্বতী আছেন। জৈন ধর্মাবলম্বীরাও মাঘী শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে উপবাস থেকে পুস্তক, লেখনী, মস্যাধার প্রভৃতি বিদ্যারাধনার উপকরণকে বিশেষ যত্মসহকারে স্থাপন করে পূজা করে থাকেন। এই দিনটি জৈনদের মধ্যে জ্ঞানপঞ্চমী বা বিদ্যাপঞ্চমী নামে অভিহিত। জৈন ধর্মগ্রন্থে ষোলো প্রকারের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। তারা হলেন- দেবী কালী, মহাকালী, দেবী রোহিণী, দেবী মানবী, দেবী গান্ধারী, বাণী চক্রেশ্বরী, সরস্বতী গৌরী, প্রজ্ঞপ্তি দেবী, মানসী দেবী, বাণী বৈরাটী, সরস্বতী অচ্যুতা, বজ্রশৃঙ্খলা দেবী, দেবী বজ্রাঙ্কুশা, মহাজ্বালা দেবী, মহামানসী দেবী ও পুরুষদম্ভাভারতী। তাদের কেউ বা দ্বিভুজা, কেউ বা চতুর্ভুজা এবং হংস, কোকিল, ময়ূর, সিংহ, গোধা, মহিষ, মৃগ, সর্প বা গোবাহনা। জৈন সম্প্রদায় হয়তো চৌষট্টি কলার প্রধান চতুর্থাংশ কলা ও বিদ্যার দেবী রূপে এই ষোলো প্রকারের সরস্বতীর কল্পনা করে থাকবেন। তাদের মতে এই ষোড়শ বিদ্যা দেবীর কেউ জ্ঞান, কেউ ভক্তি, কেউ সংযম, কেউ প্রতিভা, কেউ তপস্যা, কেউ বা বিনয় দান করে থাকেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা যে বিদ্যা দেবীর আরাধনা করে থাকেন তার বর্ণ নীল। এই দেবী নীলকমলাসনা এবং ডমরু ও শূলধারিণী। বৌদ্ধরা মনে করেন তার অর্চনায় সর্ববিদ্যা লাভ হয়।
শ্বেত বর্ণের মাঝে শুভ্রতা, আছে পবিত্রতা- জ্ঞানের প্রকৃত বর্ণও শ্বেত। তাই জ্ঞান ও নির্মলতার মূর্ত প্রতীক এই দেবী সরস্বতীর সবই শ্বেত বর্ণ। দেবী সরস্বতী সত্ত্বগুণময়ী। সত্ত্বগুণ প্রকাশাত্মক, শ্বেতবর্ণটিও প্রকাশধর্মী। দেবী সরস্বতী সূর্যসমা জ্যোতি প্রকাশক। লেখনী পুস্তক মস্যাধার বীণা শঙ্খ শৃঙ্খল হংস কোকিল ময়ূর কমল প্রভৃতি বিদ্যা ও কলার প্রধান অঙ্গ বলে সরস্বতী পূজার সঙ্গে এগুলোরও পূজা হয়ে থাকে। সরস্বতীর প্রাচীনতম প্রতীক বীণা এবং দ্বিতীয় প্রাচীনতম প্রতীক পুস্তক। দেবী সরস্বতীর প্রাচীনতম মূর্তি পাওয়া যায় ভারহুতে খ্রিষ্ট-পূর্ব প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে। দ্বিভুজা বীণা বাদনরত এই দেবী পদ্মের ওপর দণ্ডায়মান। মথুরার কঙ্কালী টিলায় পাওয়া মূর্তির হাতে প্রথম পুস্তক পাওয়া যায়। দুই পাশে দু'জন অনুচর দাঁড়িয়ে আছে। পাদপীঠে কুষাণ যুগের ব্রাহ্মী অক্ষরের পরিচয় রয়েছে। মূর্তিটি ১৩২ বা ১২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি জৈন বিদ্যাদেবী। লখনৌ জাদুঘরে এই মূর্তি সংরক্ষিত আছে। তাঞ্জোরে বৃহদীশ্বর মন্দিরে পাওয়া দেবী সরস্বতী দ্বিভুজা বীরাসনে উপবিষ্ট, পুস্তকহস্ত। মূর্তির ওপরে একটি গাছ- যেমন জ্ঞানের প্রতীক বোধিবৃক্ষ। গীতায় আছে, 'ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে' অর্থাৎ এই জগতে জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র আর কিছু নেই। আরও বলা হয়েছে, শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ অর্থাৎ যিনি শ্রদ্ধাবান, একনিষ্ঠ ও সংযমী তিনিই জ্ঞানলাভ করেন। অর্থাৎ তিনিই দেবী সরস্বতীর কৃপালাভে ধন্য হন। তাই দেবী সরস্বতীর কৃপা লাভ করতে গেলে আমাদের অধ্যবসায়ী ও সংযতচিত্তধারী হতে হবে। বিদ্যার্থীদের কাছে এই মাঘি শুক্লপঞ্চমী তিথিটির তথা সরস্বতী পূজার দিনটির আবেদন অতি গভীর। এই বিশেষ দিনটির জন্য তারা সারা বছর উন্মুখ আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। এই দিনটিকে বিদ্যার্থীরা লেখাপড়া, গানবাজনা, চিত্রাঙ্কন প্রভৃতি সর্বপ্রকার বিদ্যানুশীলন থেকে সাধারণত বিরত থাকে।
- বিষয় :
- বিদ্যার দেবী
- বিদ্যাদেবী
- সরস্বতী