ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

শহীদমাতা জাহানারা ইমাম ও একাত্তরের দিনগুলি

শহীদমাতা জাহানারা ইমাম ও একাত্তরের দিনগুলি

জাহানারা ইমাম- ফাইল ছবি

মার্জিয়া লিপি

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২১ | ০৯:২০

শহীদজননী, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক জাহানারা ইমাম। ডাকনাম জুড়ূ। জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে পশ্চিমবঙ্গের মুশির্দাবাদে; মৃত্যু ২৬ জুন, ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। জাহানারা ইমামের বাবা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মা সৈয়দা হামিদা বেগম। 

একাত্তরের ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী ও আহ্বায়ক অভিহিত করা হয় জাহানারা ইমামকে। একাত্তরে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শফি ইমাম রুমী দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। সফল কয়েকটি গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং পরবর্তীতে শহীদ হন। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। রুমীর শহীদ হওয়ার সূত্রেই তিনি শহীদজননীর মর্যাদায় ভূষিত হন।

জাহানারা ইমামের লেখা 'একাত্তরের দিনগুলি' এক সাধারণ বাঙালি শাশ্বত মায়ের ব্যক্তিগত ডায়েরি, যা বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় দলিল। 'একাত্তরের দিনগুলি' থেকে উদ্ধৃতি, "ছেলে যদি অন্য ছেলেদের মতো বিছানায় পাশবালিশ শুইয়ে রেখে যেত, তাহলেই বেঁচে যেতাম।" ছেলে তার আইএসসি পাস করেছে, ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে; আবার আমেরিকায় ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও ভর্তি এপ্রিলের শেষে (১৯৭১), সে যেতে চায় আমেরিকায়। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হন মা জাহানারা ইমাম। একদিকে দেশের প্রতি দায়, অন্যদিকে মায়ের ভালোবাসা। শেষ পর্যন্ত জাহানারা ইমামের বিবেকবোধ জয়ী হয়, জয়ী হয় দেশপ্রেম।

৩ মে সোমবার ১৯৭১, মা জাহানারা ইমামের জন্মদিনে রুমী একটি বই উপহার দিয়ে বলেছিল, 'আম্মা এই বইটা তুুমি পড়লে মনে অনেক জোর পাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতে জার্মানি অতর্কিত আক্রমণ করে পোল্যান্ড দখল করে নেবার পর সেখানে পোলিশ ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে পোলিশরা যে অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তোলে তারই কাহিনী এটা। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কীভাবে তাঁরা লড়াই করে গেছে, লড়াই করে মরেছে, তবু মাথা নোয়ায়নি, তারই কাহিনী এটা। এই বইটা পড়লে তোমার মনের সব ভয় চলে যাবে, সব দুঃখ তুচ্ছ হয়ে যাবে। জার্মানরা ইহুদিদের মানুষ বলে গণ্য করত না। পশ্চিম পাকিস্তানিরাও আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, মুসলমান বলেও গণ্য করে না। অথচ ওদের চেয়ে আমরা বহুগুণে খাঁটি মুসলমান। পড়লে তুমি বুঝতে পারবে, এই বইতে যা লেখা আছে, দেশ আর জাতির নাম বদলে দিলে তা অবিকল বাংলাদেশ আর বাঙালির দুঃখের কাহিনী, প্রতিরোধের কাহিনী, বাঁচা-মরার লড়াইয়ের কাহিনী বলে মনে হবে।'

উনিশত একাত্তরের ৬ মে বৃহস্পতিবার রুমী রওনা হয়। এর আগের দিন মা, রুমীর প্যান্টের কোমরের কাছে ভেতর দিকে মুড়ির সেলাই খুলে সেখানে কয়েকটা ১০০ টাকার নোট লম্বালম্বি ভাঁজ করে রেখে আবার মুড়ির সেলাই করে দেন। কাপড়-জামা রাখার জন্য রুমী সঙ্গে নেয় একটা ছোট আকারের এয়ারব্যাগ। তাতে দু'সেট কাটা কাপড়, তোয়ালে, সাবান, স্যান্ডেল আর দুটো বই- কবি জীবনানন্দ দাশের।

৬ মে জাহানারা ইমাম নিজে গাড়ি চালিয়ে সন্তানকে এগিয়ে দেন অনিশ্চিত এক যাত্রাপথে। বিদায়ক্ষণে বলেছিলেন, 'দিলাম তোকে দেশের জন্যে কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা।' ছেলে আগরতলায় গেল, আগরতলায় ট্রেনিং নিয়ে ঢাকা শহরে ফিরে এসে অংশ নিল গেরিলা অপারেশনে। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট, পাকিস্তানি সৈন্যরা ঘেরাও করে জাহানারা ইমামের বাড়ি। মা জাহানারা ইমাম ও সন্তান শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুমী অসতর্কতার কারণে হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে। রুমীকে ধরে নিয়ে যায়, সঙ্গে তার ছোট ভাই জামী আর বাবা শরিফ ইমামকেও। বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত জামী আর শরিফ ইমাম ফিরে এলেন, রুমী আর ফিরে আসে না। একটা রক্ত হিম করা গুজব কানে আসে। ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নাকি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

গুজবটা শুনে প্রথমে স্তম্ভিত বাকহারা হয়ে রইলেন মা জাহানারা ইমাম। খবরটার সত্যাসত্য বিশ্নেষণ করার চেষ্টা করলেন। মনে করার চেষ্টা করেন 'শিমুল' এর কথা। ৪ সেপ্টেম্বরের রাত থেকে আলতাফ মাহমুদকে রমনা থানায় আনেনি, সে খবরটার মূল তাৎপর্য এই- তাহলে কি সত্যি সত্যি ওই চার সেপ্টেম্বরের রাতেই আলতাফ, বদি, জুয়েল, আজাদ, রুমী? এর পরের কয়েক দিনের অনুভূতির বর্ণনা তার ভাষায়- "মাঝে-মাঝে নিঃশ্বাস আটকে আসে। ... বুক খাঁ খাঁ করছে, ... আকাশের বুকেও অনেক ব্যথা। তার কিন্তু আমার মতো চেপে রাখার দায় নেই। তাই সেও ক'দিন থেকে মাঝে-মাঝে অঝোরে ঝরাচ্ছে।" অবশেষে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় আসে। কিন্তু রুমী ফিরে আসে না, রুমীরা আর ফিরে আসে না। স্বামী শরিফ ইমামও চলে যান না ফেরার দেশে। আমৃত্যু প্রতীক্ষা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের জন্য এক মায়ের। মা আজীবন আফসোস করতেন, কেন তিনি সেদিন বলতে গিয়েছিলেন ওই কথা। যদি বলতেন, 'যা যুদ্ধে, ফিরে আয় বীরের বেশে, হয়তো তাই হতো।' 

দিনলিপিতে লেখেন চূড়ান্ত বিজয়ের কথা। ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার ১৯৭১- 'আজ ভোরে বাসায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হল। মঞ্জুর এসেছিলেন, বাড়িতে যাঁরা আছেন, তারাও সবাই ছাদে উঠলেন। ২৫ মার্চ থেকে ফ্ল্যাগপোলটায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে আবার নামিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেই ফ্ল্যাগপোলটাতেই আজ আবার সেদিনের সেই পতাকাটাই তুললাম। সবাই কাঁদতে লাগলেন। আমি কাঁদতে পারলাম না।'

'সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশি রক্তে দাম দিতে হয়েছে যে কান্নার স্রোতে হাসি ডুবে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে।'

খুব সাধারণ এক গল্পের অসাধারণ আখ্যান হয়ে ওঠার কাহিনি- 'একাত্তরের দিনগুলি'। কতবার যে পড়েছি। অনেকের মতো প্রতিবারই আমারও মনে হয় কোনো ছবির দৃশ্য দেখেছি।

শেষের কয়েকটা পাতা যখন পড়ি তখন অঝোরে কাঁদি। বুকের ভেতরে বায়বীয় কষ্ট পাথর হয়ে থাকে। অনেক আগে, অ্যালেপ হ্যালির 'রুটস' এর গীতি সেনের অসাধারণ অনুবাদ, 'শিকড়ের সন্ধানে' পড়েছিলাম। প্রতিটি অনাগত শিশুকে তার নিজের পূর্বপুরুষের মহৎ সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের ইতিহাস জানাতে হয়। একটা মায়ের গর্ভধারণের, সন্তান সৃজনের সময়কাল 'নয় মাস'। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর- এই ৯ মাসে একটা দেশের জন্ম হয়। একাত্তরের দিনগুলিতে একজন মা তার সন্তানকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।প্রতিটি বই, প্রতিটি গল্পই একটি জীবন ইতিহাস, কিন্তু জীবন দিয়ে যে ইতিহাস লেখা, ইতিহাসে তা কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়।

'ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস' করে দীর্ঘদিন একাত্তরের ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীসহ স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। জীবনের শেষ মুহূর্তেও তিনি তার দায়িত্বের কথা ভুলে যাননি। মৃত্যুর আগে কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি লিখে গেছেন দেশবাসীর উদ্দেশে তার শেষ চিঠি, যা আজও খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একজন জাহানারা ইমামের আদর্শ ধারণ বড্ড বেশি প্রয়োজন ...

"সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,

আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণকামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা-আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।

এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই।" জাহানারা ইমাম

আরও পড়ুন

×