ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

দুর্বলতা বোধ করছেন কারণটা খুঁজুন

দুর্বলতা বোধ করছেন কারণটা খুঁজুন

.

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী

প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ০৯:৩৪ | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪ | ১২:১৫

কখনও কখনও অফিসে বসেই ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চায় অনেকের। অবসাদ, ক্লান্ত, নির্জীব আর ঘুম ঘুমভাব বা আলসেমি লাগার নানা কারণ থাকতে পারে। প্রায় সময় চিকিৎসকের চেম্বারে এসে আমরা বলে থাকি–ভালো লাগছে না, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে, কাজের প্রতি মন বসছে না, বেশি বেশি ঘুম হয়, ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হয়, ক্লান্তি বোধ হচ্ছে, কাজে গতি আসছে না, শরীর নাড়াতে কষ্ট হয়, আলসেমি লাগছে ইত্যাদি। এগুলো হলো শরীরের দুর্বলতার লক্ষণ। ক্লান্তি বা অবসন্নতার উল্লেখযোগ্য সাতটি কারণ তুলে ধরা হলো–

পানিশূন্যতা/শরীরে লবণের ঘাটতি

ক্লান্তির একটি বড় কারণ পানিশূন্যতা। ব্যায়াম করুন বা সারাদিন বসেই কাজ করুন, শরীরে পানি চাই–শরীর শীতল থাকা চাই। পিপাসা পেলে বোঝা গেল শরীরে পানির প্রয়োজন। সারাদিন অন্তত ১০-১২ গ্লাস পানি পান করুন। তাহলে শরীর হালকা লাগবে। যারা শরীরর্চচা বা ব্যায়াম করেন, তারা শরীরচর্চার আধা ঘণ্টা আগে দুই গ্লাস পানি পান করুন। পানিশূন্যতায় যে ক্লান্তি ঘটে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ডায়রিয়া। এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে এবং শীতকালে পরিশ্রম করলেও পানিশূন্যতা অনেক সময় অনুভূত হয় না। শরীরে তখন খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রাম নেওয়ার পরও রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে। আবার ডায়রিয়া থেকে সুস্থ হওয়ার পরও পানি ও লবণশূন্যতা সেভাবে পূরণ না হওয়ায় শরীরে ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।

অনিদ্রা এবং স্লিপ অ্যাপনিয়া  

ঘুমের সমস্যা/অনিদ্রা থেকে ক্লান্তি আসে। ঘুম খুব কম হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। পূর্ণবয়স্কদের প্রতি রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম হওয়া উচিত। সারাদিনের কর্মক্ষমতার জন্য ঘুম একটি বড় অগ্রাধিকার। ঘুমের একটি নিয়মিত রুটিন থাকা দরকার। শোবার ঘর রাখতে হবে অন্ধকার, শীতল এবং শান্ত। আবার অনেকে মনে করেন নাক ডেকে বেশ ঘুম হচ্ছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যে সাময়িক শ্বাসরোধ বা শ্বাসবন্ধ হয়ে জেগে ওঠা নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সারারাত ধরে ১০ সেকেন্ডের এমন শ্বাসবিরতিকে স্লিপ অ্যাপনিয়া বলে। এর ফলে ঘুম পরিমাণমতো হলেও ঝিমুনি ভাব চলে আসে এবং শরীর ক্লান্ত লাগে। 

রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া: রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে এ অবস্থাকে অ্যানিমিয়া বলে। মহিলাদের ক্লান্তির অন্যতম কারণ হলো রক্তস্বল্পতা। ঋতুস্রাব/মাসিকের সময় অধিক রক্তক্ষয় হলে লৌহ বা আয়রনের ঘাটতি হয়ে থাকে। মেয়েরা তাই রক্তস্বল্পতার ঝুঁকিতে বেশি থাকে। রক্তের হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন বহন করে কোষ ও দেহযন্ত্রে পৌঁছে দেয়। রক্তের হিমোগ্লোবিন সেই সূত্রে আয়রন কমে গেলে কোষ ও দেহযন্ত্র স্বভাবতই হাঁপিয়ে ওঠে। রক্তস্বল্পতা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শে লৌহপরিপূরক ওষুধ বা আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে। এ ছাড়া লিভার/কলিজা, কচুশাক, লালশাক রক্তস্বল্পতায় খুবই কার্যকর; তাই বেশি করে খেতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতাজনিত দুর্বলতা রোধে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে হবে। 

হাইপোথাইরয়েডিজম: দেহের বিভিন্ন ধরনের হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ক্লান্তিবোধ আসতে পারে। মানুষের শরীরের অন্যতম প্রধান নালিবিহীন গ্রন্থি বা এন্ডোক্রাইন গ্লান্ড হচ্ছে থাইরয়েড গ্রন্থি। এ গ্লান্ডটি গলার সামনের অংশে অবস্থিত। আমাদের দেহের বিপাকীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাইরয়েড গ্রন্থি। কোনো কারণে থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন উৎপাদন কমে গেলে তাকে হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। গ্রন্থির কাজকর্ম কমে গেলে বিপাক চলে ধীরে ধীরে। ফলে শরীরে এনার্জি কম উৎপন্ন হয়, শরীরের গতি স্লথ হয়ে যায় এবং ঝিমুনি ভাব চলে আসে। 

ডায়াবেটিস : ডায়াবেটিস হলে সুগার/গ্লুকোজ দেহকোষে না ঢুকে ক্রমাগত বাড়তে থাকে রক্তে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় ইনসুলিন হরমোনের সহায়তায় সুগার দেহকোষে ঢুকে শক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার কথা। কিন্তু ইনসুলিনের অভাবে ডায়াবেটিসের কারণে শরীর হয়ে পড়ে অবসন্ন ও শক্তিহীন। এ জন্য অল্পতেই কারও যদি ক্লান্তি ভর করে, কিছুক্ষণ কাজ করলেই যদি ঝিমুনি ভাব চলে আসে সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করানো উচিত। 

হৃদরোগ : যে কাজগুলো একসময় সহজ মনে হতো সেগুলো এখন কঠিন মনে হচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে গেলে যদি সহজেই হাঁপিয়ে উঠছেন, তখন বুঝতে হবে হয়তো হৃদযন্ত্র বা হার্ট সচল আছে কিনা সেদিকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্মে ক্লান্তি ভর করলে বা অল্পতেই শরীর দুর্বল হয়ে ঝিমুনি ভাব চলে এলে, বুক ধড়ফড় করলে, বুকের মাঝখানে চাপ অনুভব করলে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ হৃদরোগও হতে পারে আপনার আপাত অজানা ক্লান্তির উৎস। 

খাবার গ্রহণে অনীহা/ ক্ষুধামান্দ্য ভাব : শরীরে পর্যাপ্ত জ্বালানির জোগান না থাকলে ক্লান্তি ভর করে। অনেকক্ষণ ধরে না খেলে রক্তে সুগার কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইসেমিয়া দেখা দিতে পারে। এটি বিপজ্জনক বিষয়। তাই হেলাফেলায় সকালের নাশতা কখনও যেন বাদ না যায়। প্রতিবেলার খাবারে যেন অবশ্যই প্রোটিন এবং শর্করা থাকে। সুষম খাবার রক্তের সুগারকে স্বাভাবিক রাখে। দিনভর এনার্জি ধরে রাখার জন্য কম কম করে বিরতি দিয়ে সারাদিনের খাবার খেতে হবে। ক্লান্তির চিকিৎসা করার আগে এর অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয় করা প্রয়োজন। কারণ জানা গেলে তার ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা শুরু করা যায় এবং জীবনযাপনে পরিবর্তন আনা যায়। 

[ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ]
 

আরও পড়ুন

×