ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

দ্বিপক্ষীয় উৎসের বিদেশি ঋণ দ্রুত বাড়ছে

দ্বিপক্ষীয় উৎসের বিদেশি ঋণ দ্রুত বাড়ছে

.

জাকির হোসেন

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০১:৫১ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৭:৫৮

বহুপক্ষীয় উৎসের তুলনায় দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। চীন, জাপান, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ গত বছর শেষে দাঁড়িয়েছে মোট ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। গত এক দশকে দ্বিপক্ষীয় উৎসের ঋণ বেড়ে ছয় গুণ হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় উৎস থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও কম। এ সময়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ বেসরকারি উৎসের ঋণ বেড়ে চার গুণ হয়েছে।

মোট দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যে ২০২২ সাল শেষে বহুপক্ষীয় ঋণদাতার অংশ ছিল ৫৩ শতাংশ। ২০১২ সালে যা ছিল ৭৫ শতাংশ। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় উৎসের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। ২০১২ সালে এ উৎসের অংশ ছিল ১৫ শতাংশের মতো। বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ চলতি বছর কম আসার প্রবণতা থাকলেও এর আগে পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। 

এ ছাড়া বাংলাদেশের ঋণের ২০ শতাংশের বেশি এখন স্বল্পমেয়াদি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ কম সুদের নমনীয় ঋণ থেকে উচ্চ সুদের এবং কম মেয়াদকালের ঋণের দিকে যাচ্ছে, যা আগামীতে পরিশোধের চাপ আরও বাড়াবে।

বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন-২০২৩-এ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের এসব পরিসংখ্যান রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে পরিসংখ্যানের বাইরে কোনো পর্যালোচনা নেই। 
রিপোর্টে বলা হয়েছে, চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদহারের কারণে ২০২২ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো রেকর্ড ৪৪৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করেছে। 

 রেকর্ড ঋণস্থিতি এবং উচ্চ সুদের হার অনেক দেশকে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশের জন্য অধিকতর দক্ষ ঋণ ব্যবস্থাপনা জরুরি। ঋণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র দেশের ঝুঁকি বেশি। 
এ বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক দায়দেনা নিয়ে তাঁর তিনটি পর্যবেক্ষণ রয়েছে। প্রথমত, দায়দেনার চাপ বেড়েছে। গত এক দশকে বৈদেশিক দায়দেনার পরিমাণ তিন গুণ হয়েছে। পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক ঋণের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিকূলে। দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে ব্যয়বহুল ঋণ বেড়েছে। অনুদান কমে গেছে। বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ বেড়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, স্বল্পমেয়াদি ঋণ অনেক বেড়েছে। বহুপক্ষীয় উৎসের তুলনায় দ্বিপক্ষীয় এবং বেসরকারি উৎসের ঋণে সুদহার বেশি। অন্যদিকে পরিশোধের সময়কাল কম। তৃতীয়ত, এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য হলো প্রতিবছর দায়দেনা পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। লক্ষণীয় বিষয়, ঋণের অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে ঋণের পরিমাণ কম হতো।

ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, ২০২৪ সাল (আগামী বছর) থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ শুরু হলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে বাড়বে। ২০২৪ সাল থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। ঋণ পরিশোধের সঙ্গে সমানতালে রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়লে বাংলাদেশ সংকটে পড়বে। দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে এবং সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় বড় যেসব প্রকল্পে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণ আয় যদি না আসে এবং যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা না থাকে, তাহলে সংকট তীব্র হবে।

বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২০২২ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। ২০১২ সালে ছিল ৪৪ শতাংশ। 
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত এক বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমেছে। ফলে এখন এ হার আরও কম। বাংলাদেশ গত বছর যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করেছে, তা রপ্তানি আয়ের ১১ শতাংশ। এক দশক আগে যা ছিল ৬ শতাংশ। এক দশক আগে মোট বৈদেশিক ঋণ ও রপ্তানি আয় প্রায় সমান ছিল। এখন রপ্তানি-ঋণ অনুপাত ১৬০ শতাংশ। ২০১২ সালে মোট বৈদেশিক ঋণে স্বল্পমেয়াদি ঋণের অংশ ছিল ৭ শতাংশ। ২০১২ সালে তা বেড়ে ১৯ শতাংশ হয়েছে। ঋণের পরিমাণ এবং পরিশোধের চাপ বাড়লেও বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র দেড় বিলিয়ন ডলারের। এক দশকে যা বেড়েছে মাত্রা আধা বিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলার। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, চীনের অর্থায়নে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, রাশিয়ার অর্থায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ কিছু বড় প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের সময়সূচি এগিয়ে আসছে। কর্ণফুলী টানেলের ঋণ পরিশোধ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আবার বিশ্বব্যাংক, জাপানসহ প্রথাগতভাবে যারা কম সুদে ঋণ দিত, তারাও এখন তুলনামূলক বেশি সুদ নিচ্ছে। সব মিলিয়ে ঋণ পরিশোধের ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে এখন চীনের অংশ ৯ শতাংশ। রাশিয়ার অংশ ৮ শতাংশ। অন্যদিকে জাপানের ১৫ শতাংশ। জাপানের ঋণের সুদহার তুলনামূলক কম। দ্বিপক্ষীয় এসব উৎস থেকে এক বছরে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১-এ বেড়েছিল প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। বহুপক্ষীয় উৎস থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাড়ছে বছরে দুই বিলিয়ন ডলারের মতো। 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা জানান, বহুপক্ষীয় উৎস থেকেও এখন বাজারভিত্তিক ঋণ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ায় নির্ধারিত কম সুদের নমনীয় ঋণের অংশ কমে আসছে। বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকেও বাজারভিত্তিক সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। বর্তমানে এসব ঋণের সুদহার ৫ থেকে ৭ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে।
 
স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ১০ বছরে ৯ গুণ
বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৭৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালে স্বল্পমেয়াদি ঋণের স্থিতি ছিল দুই বিলিয়ন ডলারের কম। এর মানে এক দশকে বেড়েছে ৯ গুণ। স্বল্পমেয়াদি ঋণের বড় অংশ বেসরকারি খাতের নেওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত বছর শেষে বেসরকারি খাতের নেওয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাত এ বছর বিদেশি ঋণ নিচ্ছে কম। তবে আগের নেওয়া বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর যা বাড়তি চাপ তৈরি করছে। 

ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি
গত বছর বাংলাদেশের অনুকূলে মোট দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি ঋণ ছাড় হয়েছে ১৩ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ঋণের আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ হয়েছে ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে পরিশোধ বেড়েছে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। গত বছর বেসরকারি খাত প্রায় ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ২৪০ মিলিয়ন ডলার বেশি। অর্থনীতিবদরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের চাপ আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়বে। 

 

আরও পড়ুন

×