ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার: জাভেদ আখতার

বিদেশি বিনিয়োগ টানতে রাখতে হবে নীতির ধারাবাহিকতা

বিদেশি বিনিয়োগ  টানতে রাখতে হবে নীতির ধারাবাহিকতা

জাভেদ আখতার

 মেসবাহুল হক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০২৪ | ০০:৫৫ | আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ | ১২:৩৭

বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম। এ অবস্থা থেকে উন্নতির জন্য দেশ হিসেবে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। নীতির ধারাবাহিকতা থাকতে হবে। বিনিয়োগকারীদের মুনাফা সহজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

আগামী  অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সামনে রেখে সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে  ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও এমডি জাভেদ আখতার এসব কথা বলেন। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আরও কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার  সুপারিশ করেছেন তিনি।

বাজেট পেশের আগে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাভেদ আখতার  বলেন, গত ৩০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রতি দশক জিডিপি দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছর অভ্যন্তরীণ ও বাইরের ইস্যুতে অর্থনীতি কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। গত সপ্তাহে মুদ্রা বিনিময় হার এবং সুদহারে দুটি বড় ধরনের সংস্কার করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। তার ধারণা, এ-সংক্রান্ত আরও কিছু পরিবর্তন আসবে। এসব সংস্কারের কারণে স্বল্পমেয়াদে কিছুটা সমস্যা বাড়বে, তবে দীর্ঘমেয়াদে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়ক হবে।

তিনি বলেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনে বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবে এখনও বড় ঘাটতি রয়েছে। অর্থাৎ আমাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। এটি ঠিক করতে সরকারের রাজস্ব নীতিতে সংস্কার আনতে হবে।  ভালোমতো সংস্কার করতে না পারলে আমরা ঋণখেলাপি হয়ে যাব। ঘাটতি কমিয়ে আনতে একটা বড় ধরনের তহবিল প্রয়োজন। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে দিয়ে দিতে পারে। রেলওয়ে, বিমান, টেলিকম, জাহাজসহ বিভিন্ন খাতে বেসরকারীকরণ করার সুযোগ রয়েছে। সংকটে পড়ার পর ১৯৯০ সালের দিকে ভারত এ-ধরনের সংস্কার করেছিল। সেখান থেকে তারা লাভবানও হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি কমাতে নতুন আয়ের উৎস খুঁজে বের করা প্রয়োজন।  

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাণিজ্য সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আগামী বাজেটের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ জানতে চাইলে জাভেদ আখতার বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের হার খুবই কম। এ অবস্থা থেকে উন্নতিতে আগামী বাজেটে তিনটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দেশ হিসেবে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি, ট্রেডমার্ক– এসব জিনিস ঠিক রাখাতে হবে। দ্বিতীয় হচ্ছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি। আমাদের দেশে যা নিয়ে উদ্যোক্তাদের অনেক ভুগতে হয়। তৃতীয়ত, কোম্পানিগুলো যাতে সহজে মুনাফা দেশে নিয়ে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে অনেক কোম্পানি রয়েছে তারা পেমেন্ট পাচ্ছে না। একই সঙ্গে নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। আজকে কোনো বিদেশি বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করল, আর আগামী বছর কর বেড়ে গেল– এমন হলে বিনিয়োগ আসবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেভারেজ শিল্পে টার্নওভার ট্যাক্স বেড়ে যেতে পারে– এ ধারণায় প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে। 

বাংলাদেশে কোনো বিদেশি উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করতে চাইলে কোন খাতে কী সুবিধা জানতে পারে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, একই সঙ্গে বিনিয়োগের পরও তাদের কেয়ার করতে হবে। সার্বিকভাবে ট্যাক্স সিস্টেমকে ডিজিটালাইজড করতে হবে। তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরে করপোরেট করহার কমানো হয়েছে। আগামী বাজেটও কমবে শোনা যাচ্ছে যা খুবই ভালো পদক্ষেপ। বর্তমানে পুঁজিবাজারে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের শর্ত জুড়ে দেওয়ার কারণে প্রায়োগিক বা কার্যকর করহার দাঁড়ায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ। কারণ বাড়তি উৎসে করের পাশাপাশি অবসরকালীন সুবিধা, প্রমোশনাল ব্যয়সহ অনেক খরচকে অনুমোদনযোগ্য ধরা হয় না। এসব বিষয়কে আরও সহজ করে কার্যকর কর কমিয়ে আনতে হবে। কাগজকলমে কর সাড়ে ২৭ আর দিন শেষে যদি দিতে হয় ৪৫ শতাংশ, তাহলে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে না। 

তিনি বলেন, করহার কমানোর ফলে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি রাজস্বও বাড়বে।  সরকারের রাজস্ব বাড়াতে হবে। রাজস্ব না পেলে সরকার মৌলিক জায়গায় অর্থাৎ স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করবে না। এসব জায়গায় সরকারের বিনিয়োগ কমে গেলে বেসরকারি খাতের ব্যবসাও বাড়বে না। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে দ্বৈতকরের বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।   

দেশের শীর্ষস্থানীয় এফএমসিজি কোম্পানির নেতৃত্বের জায়গা থেকে এ খাতের জন্য বাজেটে কী পদক্ষেপ চান এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন– দেশি-বিদেশি যে কোনো উদ্যোক্তার জন্য কার্যকর করহার বাংলাদেশে বড় চ্যালেঞ্জ, যা কমিয়ে আনতে হবে।  বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন হারে ভ্যাট রয়েছে। ২০১২ সালের ভ্যাট আইন অনুযায়ী ভোক্তা পর্যায়ে একটি আদর্শ হার হলে আদায় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে, চূড়ান্ত হিসাবে ভোক্তাকেও কম ভ্যাট দিতে হবে। 

তিনি বলেন, ভারতের ভ্যাট আইন আমাদের চেয়ে খারাপ ছিল। কিন্তু পরে অনেক সহজ করেছে। আমদানি শুল্কের পরও বাড়তি সম্পূরক ও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক দেওয়া হয়। এগুলো কমিয়ে আনতে হবে। বিলাসী পণ্যের উল্লেখ করে হয়তো ২৫ বছর আগে শ্যাম্পু আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে এখন শ্যাম্পু প্রয়োজনীয় পণ্য। তারপর এখনও  সম্পূরক শুল্ক অব্যাহত রাখা হয়েছে। এসব কারণে কোম্পানি পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। 

রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কারের সুপারিশ করা হচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। আসলে কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার করলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে বলে মনে করেন– এমন প্রশ্নে জাভেদ আখতার বলেন, রাজস্বের ক্ষেত্রে পরোক্ষ কর-নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় অটোমশনের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে নীতিগত ও অবকাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য একটি ইন্ট্রিগ্রেটেড ডিজিটাল ইকোসিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। এর আওতায় এনবিআরের তিন বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক, বিআরটিএসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে করের আওতা বাড়াতে হবে। যারা কর দেয় তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি না করে করের আওতা বাড়াতে পারলে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে।   

দেশের আর্থিক খাত নিয়ে পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আর্থিক খাতের পতনের কারণেই সার্বিক অর্থনীতির পতন হয়। আমাদের জন্য এখন এ খাত একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এ খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। 

আরও পড়ুন

×