কমার্স ব্যাংকে দুর্নীতি
আমানত পেতে মোটা অঙ্কের ঘুষ
ভুয়া ভাউচারে দেখানো হয়েছে বিধিবহির্ভূত ব্যয়

লোগো
ওবায়দুল্লাহ রনি
প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:৪৫ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ | ০৯:২৫
অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে এবং আমানত পেতে ঘুষ দিয়েছে সমস্যাকবলিত বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটি বিভিন্ন সময়ে ‘ব্যবসা উন্নয়ন খরচ’-এর নামে ভুয়া ভাউচার দিয়ে অনেক ব্যয় সমন্বয় করেছে। ভাউচার দেওয়া হয়নি, টাকাও সমন্বয় হয়নি– এমন ঘটনাও রয়েছে। ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি থাকা এ ব্যাংক থেকে এভাবে অস্বাভাবিক ও অস্বচ্ছ ব্যয় করা হয়েছে। ব্যাংকটির সদ্য পদত্যাগকারী এমডি ‘ঘুষ’-এর কথা না বললেও আমানত পেতে অর্থ খরচের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন ও ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কমার্স ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ১১ জুন থেকে গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ মাসে শুধু ব্যবসা উন্নয়ন খরচের নামে ১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। আবার শাখা-উপশাখার জন্য খরচ দেখালেও দেড় কোটি টাকার কোনো ভাউচারের হদিস নেই। এর বাইরে অতিরিক্ত খরচ দেখানো হয়েছে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এদিকে সমস্যাগ্রস্ত অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আমানত পেতে কোনো খরচ করার সুযোগ নেই। অথচ কমার্স ব্যাংক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত আনতে বিপুল অঙ্কের খরচ দেখিয়েছে। মূলত যে প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত আনা হয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে অর্থ দেওয়া হয়। তবে ঘুষের নামে যেহেতু কোনো খরচ দেখানো যায় না, সেহেতু তারা ব্যবসা উন্নয়নের নামে এ খরচ দেখিয়েছে। বিভিন্ন নামে ভুয়া ভাউচার করে তা আবার সমন্বয় করা হয়েছে। এটি বড় ধরনের অপরাধ। যে কারণে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে সরকারের শেয়ার রয়েছে ৫১ শতাংশ।
আর বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার রয়েছে ৩৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০১৭ সাল থেকে কমার্স ব্যাংকে কর্তৃত্ব ছিল এস আলম গ্রুপের। কমার্স ব্যাংক ২০১৮ সাল থেকে লোকসানে রয়েছে। সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৩ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আতাউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে পাঁচ সদস্যের পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। আতাউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসরের পর ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছর এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রধান ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে পরিচালিত ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ১১ জুন থেকে গত ৪ আগস্ট পর্যন্ত ব্যবসা উন্নয়ন খরচ বাবদ ‘সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট’ থেকে মোট ১৫ কোটি ৭৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। আমানত সংগ্রহ, নবায়নসহ বিভিন্ন খাতে যার ব্যয় দেখানো হয়। বিভিন্ন খাতের নামে ভাউচার তৈরি করে এসব ব্যয় সমন্বয় করা হয়েছে। তবে সমন্বয় হয়নি ১ কোটি ৩৪ লাখ ২৫ হাজার টাকার। অসমন্বিত অর্থের মধ্যে গত ১৪ জুলাই প্রাধান কার্যালয়ের আর্থিক প্রশাসন বিভাগ থেকে নগদে আট লাখ টাকা উত্তোলন দেখানো হয়। অর্থ উত্তোলনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ‘ডিএমডি-১ মহোদয়ের দপ্তর (এফএডি দুদক)।’ এর বেশি কিছু লেখা হয়নি। আর গত বছরের জুনে ঢাকা ‘জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ-২০২৩’-এর আয়োজন সফল করতে দেওয়া হয় ১৭ লাখ টাকা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব অর্থ দেওয়া হয় বলে মনে করে নিরীক্ষা দল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের অর্থ দেওয়ার ক্ষমতা কেবল পরিচালনা পর্ষদের। অথচ ব্যাংকটির এমডির চলতি দায়িত্বে থাকা আবদুল কাদের দিলকুশা শাখা থেকে গত বছরের ৪ জুন ‘০৪৮২৩৭৬ নম্বর’ পে-অর্ডারের বিপরীতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে অর্থ দেন। অসমন্বিত অর্থের মধ্যে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় আগ্রাবাদ শাখার অনুকূলে, যার কোনো ভাউচার দেওয়া হয়নি। ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখার সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে অসমন্বিত আছে ৭৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা। গুলশান শাখার অনুকূলে অসমন্বিত রয়েছে ১৫ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অর্থের সবই নগদে বিভিন্ন ব্যক্তি উত্তোলন করেন। নগদে কে অর্থ নিয়েছেন, তা ভাউচারে লেখা নেই। তবে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা পরিদর্শন দলকে জানিয়েছেন, সাবেক ডিএমডি আবদুল কাদেরের মৌখিক নির্দেশে এসব অর্থ দেওয়া হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা যা উত্তোলন করেন। সরকার পতনের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে গত ১১ আগস্ট পদত্যাগ করেন আবদুল কাদের। এর পর থেকে তিনি পলাতক। ব্যাংকটির নবগঠিত পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশে গত ১৫ অক্টোবর পদত্যাগ করে ব্যাংক ছাড়েন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলাম।
হদিস মেলেনি ভাউচারের
একটি ব্যাংক শাখা-উপশাখা স্থাপন ও স্থানান্তরে কেমন ব্যয় করতে পারবে, তার একটি সীমা নির্ধারিত আছে। তবে কমার্স ব্যাংকে নির্ধারিত সীমা অমান্য করে নতুন শাখা স্থাপন ও স্থানান্তরে ৬ কোটি ৩০ লাখ ১৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয়ের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান পরিদর্শনে উঠে এসেছে, ১ কোটি ৫০ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ব্যয়ের কোনো নথি পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ২২টি উপশাখার এসি স্থাপন বাবদ ৭৬ লাখ ৪৯ হাজার টাকা খরচ দেখানো হলেও তার কোনো ডকুমেন্ট নেই। নথি গায়েব হলেও কোনো সাধারণ ডায়েরি করেনি ব্যাংক। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি এস আলমের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর থেকে মোট ২৯টি শাখা এবং ৩৩টি উপশাখা স্থাপন ও স্থানান্তরে বাড়তি এ ব্যয় করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তথ্য গোপন করতে প্রতিটি শাখা বা উপশাখার জন্য তিনটি নথি তৈরি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে ব্যাংকটির সদ্য পদত্যাগী এমডি তাজুল ইসলাম যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সত্য নয়। আবার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অতিরিক্ত ব্যয়ের অনুমোদন দিয়েছে। এসব বিষয়ে ব্যাংকটির সাবেক ও বর্তমান ৬২ কর্মকর্তার লিখিত জবাব চাওয়া হয়েছে।
অন্য প্রতিষ্ঠানে ১,৩০৬ কোটি টাকা রেখে বিপদে ব্যাংক
সংকটে থাকা কমার্স ব্যাংক অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখে এখন আর ফেরত পাচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখেছে, অনেকেই আমানতকারীর টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ফলে বিপদে পড়েছে ব্যাংকটি। বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে রয়েছে ২৬০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১৭৫ কোটি, ইউনিয়ন ব্যাংকে ১৪১ কোটি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ৩০ কোটি টাকা। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আভিভা ফাইন্যান্সে রয়েছে ২৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া পিপলস লিজিংয়ে ১৫৪ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ১৪৮ কোটি, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ২০ কোটি, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ৯ কোটি এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মোট ঋণ রয়েছে ২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫৬ শতাংশ। ব্যাংকটিতে কাগজ-কলমে এস আলম গ্রুপের ঋণ ৪৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
যা বললেন সাবেক এমডি
কমার্স ব্যাংক থেকে সদ্য পদত্যাগকারী তাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দুর্বল ব্যাংককে তো কেউ টাকা দেয় না। যে কারণে কিছু বাড়তি খরচ করতে হয়। এখান থেকে এক টাকাও ব্যাংকের কারও পকেটে যায়নি। প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংক এ খরচ করে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে আমানত আনতে কিছু খরচাপাতি করতে হয়।
শাখা খোলায় অতিরিক্ত ব্যয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডেকোরেশন, ভল্ট, কম্পিউটারের খরচ বাদ দিয়ে হিসাব করেছে। এসব যোগ করলে খরচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সীমার মধ্যেই আছে। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক আগেই টাকা রাখা হয়েছিল। অবশ্য সমস্যাকবলিত ব্যাংকে আমানত রাখার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানার জন্য ব্যাংকটির সাবেক ডিএমডি আবদুল কাদেরকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির অন্য এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব জেনেও এতদিন নীরব ছিল। সরকার পতনের পর এখন সক্রিয় হয়েছে।
- বিষয় :
- ব্যাংকে প্রতারণা