রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আসবে না

.
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫ | ২৩:৫৬
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিহত করতে যা সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তবে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া কোনো তদারকি ব্যবস্থা কাজে আসবে না। ফলে যে রাজনৈতিক সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে।
গতকাল সোমবার ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা (আরবিএস) চালু উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। এ সময় ডেপুটি গভর্নরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকতা উপস্থিত ছিলেন।
গভর্নর বলেন, তদারকি ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে আরবিএস চালু করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ২০টি ব্যাংকের ওপর পরীক্ষামূলক তদারকি করা হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে বাকি ৪১টি ব্যাংকে এ ব্যবস্থা সম্পন্ন হবে। আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে পরিপূর্ণভাবে ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি করা হবে। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঝুঁকির ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তখন অফসাইট, অনসাইট আলাদা তদারকি হবে না। আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশ এ ব্যবস্থায় তদারকি করছে। পরবর্তী ধাপে ২০২৮ সালের জানুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড আইএফআরএস-৯ চালু হবে। আরবিএস নিয়ে প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, গত দু’বছর ধরে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিহত করতে যা সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে কতটা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যায়, এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আমাদের প্রত্যাশা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কেউ যেন রাজনৈতিকভাবে প্রতিহত না করে। আগামীতে যেন নির্মোহভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করলেই কি ব্যাংক খাতের অনিয়ম-জালিয়াতি বন্ধ হবে– এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘আগেও বলেছি, এখনও বলছি– রাজনৈতিক সরকার যদি মনমানসিকতার পরিবর্তন না করে, কোনো তদারকি ব্যবস্থাই কাজে আসবে না। সেটা আমরা গত ১৫ বছরে দেখেছি। ফলে যে রাজনৈতিক সরকারই থাকুক না কেন, তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে যত্নশীল হতে হবে। আইন ভেঙে তো আর আইন পালন করা যাবে না।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনিয়ম-জালিয়াতি প্রতিহত করা বাংলাদেশ ব্যাংকের একার বিষয় নয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যদি গুণগত পরিবর্তন আনতে না পারি, আবারও এরকম হতে পারে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফলে এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রাজনীতিবিদদের ভবিষ্যৎ বুঝতে হবে। অনিয়ম-জালিয়াতি করলে কী পরিণতি হয়, রাজনীতিবিদরা তো দেখছেন। একটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো, এসবের পরিণতি দেশের জন্য ভালো হয় না, তাদের জন্যও ভালো হয় না। রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যাওয়া কি তারা চান? তারা তো চান না। এসব করে সাময়িকভাবে হয়তো উপকৃত হয়। তবে সামগ্রিকভাবে একটা রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য ভালো হয় না।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, কোনো একটা দিক সমাধান করে সব কিছুর সমাধান হবে না। অনেকগুলো দিক নিয়ে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েই কাজ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনগত ক্ষমতা, স্বায়ত্তশাসন থাকলে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা যায়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হলে অবশ্যই সব অনিয়ম-জালিয়াতি শনাক্ত করা সম্ভব। আগের সব অনিয়ম তো শনাক্ত হয়েছে। তবে লাভ হয়নি। কেননা, সেখানে রাজনৈতিকভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, ‘এই জায়গার পরিবর্তনটা অবশ্যই রাজনীতিবিদদের করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো দেশ চালাবে না। চালাবে সরকার। আমরা আশা করব, সরকার সুবিবেচনাপ্রসূত হয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হবে নির্মোহভাবে কাজ করা। যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে অবশ্যই রোধ করা সম্ভব।’
গভর্নর জানান, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অর্ধেক স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে পেশাদার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল করবে। সেখান থেকে এসব নিয়োগ হবে। এখনকার মতো নিজের পরিচিতজনকে বসিয়ে দেওয়ার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্বতন্ত্র পরিচালক ছাড়া উদ্যোক্তা পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রেও যোগ্যতার মাপকাঠি অনুসরণ করা হবে। একই ব্যক্তিকে একাধিক ব্যাংকের মালিকানা দেওয়া, প্রকৃত সুবিধাভোগীকে চিহ্নিত করা, একক গ্রাহকের ঋণসীমা অমান্য করা ঠেকানো গেলে অনেক কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।
তিনি জানান, ছয়টি ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান যাচাই করে অনেক সমস্যা পাওয়া গেছে। তার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূতকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন এক্সিমসহ প্রতিটি ব্যাংকের সঙ্গে আলাদাভাবে বসা হবে। যদি কেউ দৃশ্যমানভাবে সংগত কারণ দেখাতে পারে, সেই ব্যাংক নিজের মতো চলতে পারবে। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেটা সম্ভব হবে না।
- বিষয় :
- ব্যাংক