ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নারী দিবস

সব শ্রেণির নারীকেই এগিয়ে নিতে হবে

সব শ্রেণির নারীকেই এগিয়ে নিতে হবে

শাহীন আনাম

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২০ | ১৫:০৬ | আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ | ১৫:২০

নারী শিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের নারীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে আসীন। নারীদের এই অগ্রযাত্রা গোটা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু অগ্রযাত্রার এই স্রোতে দেশের সব শ্রেণির নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হচ্ছে না। এটা সহজেই বোধগম্য যে, বাংলাদেশের সব নারী এক শ্রেণিভুক্ত নয়। এখানে শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, প্রতিবন্ধী ও সংখ্যালঘু নারী রয়েছে। সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করা হলে দেখা যাবে, কিছু নারী উচ্চশিক্ষিত ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তারা এমন পরিবার থেকে এসেছেন, যে পরিবারগুলো তাদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে, সমর্থন দেয়। সেই নারীরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সর্বক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের জায়গায় পৌঁছে গেছে। তাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সর্বজনীনভাবে বা সব নারীর ক্ষেত্রে এটা বলা যায় না। এই শিক্ষিত ও দক্ষ নারীদের বাইরে থাকা নারীরা কিন্তু এখনও নানান জটিলতার মধ্যে রয়েছে। তাদের অনেকেই বাল্যবিয়ে, পারিবারিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা অনেক দুর্বল। সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি পরিবর্তন আসছে না। এ জন্য দায়ী দারিদ্র্য, অসচেতনতা, নারীর প্রতি অসম্মান এবং নারীর কাজের অস্বীকৃতি। আমরা নারীর ক্ষমতায়নে অনেক সফল হয়েছি- এটা বলে বসে থাকার সুযোগ নেই। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমাদের দীর্ঘমেয়াদে আরও অনেক কাজ করতে হবে।

নারীর প্রতি সহিংসতা ঘরে ও বাইরে কিন্তু বাড়ছে। আমাদের দেশে এটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পারিবারিক নির্যাতনের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্তত ৭০ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে সরাসরি নির্যাতনের শিকার হয়। এ ছাড়া ঘরের বাইরে সহিংসতা, নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ ও ধর্ষণের মতো অপরাধও দূর করা যাচ্ছে না। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সহিংসতা কমাতে হলে অনেক বিষয় নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্র যে আইনগুলো করে তার বাস্তবায়ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঠিকমতো দায়িত্ব পালন, বিচার ব্যবস্থা নারীবান্ধব হওয়া ও পরিবারকে নারীর পাশে দাঁড়ানো দরকার। সহিংসতার শিকার হলে সর্বপ্রথম পরিবারকে পাশে দাঁড়াতে হবে। বিষয়টি ধামাচাপা না দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে হবে।

নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে বাল্যবিয়ে। এ জন্য পরিবারই পুরোপুরি দায়ী। পরিবার যদি সচেতন থাকে এবং নারী অবদানের কথা স্বীকার করে তাহলে বাল্যবিয়ে কমবে। পারিবারিক যে নির্যাতন হয়, সেখানে পুলিশের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। এটা পরিবারের ব্যাপার। পরিবারে নারীর সম্মান বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের দেশে অনেক পরিবারের শিশুরাই মায়ের প্রতি অসম্মান বা নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠে। তারা বড় হয়ে তাই শেখে। এ জন্য পরিবারে এমন একটি অবস্থান তৈরি করতে হবে, যেখানে নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আমাদের সমাজও নারীদের সম্মানের চোখে দেখে না। একজন নারী হেঁটে গেলে তার দিকে অনেকেই তাকিয়ে থাকে, বিভিন্ন মন্তব্য করে। সমাজ এখনও নারীদের পণ্য হিসেবে দেখে। সমাজকে বুঝতে হবে- নারীরাও পুরুষের মতো স্বাভাবিক মানুষ। তারা পুরুষের মতো বিদ্যা-বুদ্ধিসম্পন্ন। পুরুষ যেসব কাজ করতে পারে, নারীও সেসব করতে পারে স্বাভাবিকভাবেই। সমাজ ও পরিবারে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে কিন্তু সহিংসতা কমবে না।

এক সময় মনে করা হতো, নারী শিক্ষার হার বাড়লেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষায় অনেক দূর এগিয়েছে। উপমহাদেশের মধ্যে নারী শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী-পুরুষের সংখ্যায় খুব তারতম্য নেই। এর পরও যে অনেক নারী শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে না, তা কিন্তু নয়। আগে নারীদের পিছিয়ে পড়ার জন্য অর্থনৈতিক সংকট ও অসচেতনতাকে দায়ী করা হতো। এখন কিন্তু সে অবস্থা নেই। সামাজিক অনিরাপত্তার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েদের বিদ্যালয়ে যেতে দেন না। যারা উচ্চশিক্ষা অর্জন করছেন তাদের অনেকেই আবার কর্মস্থল পাচ্ছেন না। অনেকেই বুঝতে পারেন না, কোন বিষয়ে পড়া দরকার। এ ক্ষেত্রে দক্ষতা একটি বড় বিষয়। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। এখন প্রয়োজন তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলে কর্মমুখী করা। আবার যারা চাকরি শুরু করেন, পরিবার হওয়ার পর তাদের অনেককে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষদের দায়িত্ব নিতে হবে। পারিবারিক বিষয়গুলো ভাগাভাগি করতে হবে। সরকারের উচিত হবে পর্যাপ্ত ডে কেয়ার সেন্টার চালু করা, যাতে নারীরা নির্বিঘ্নে কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাতৃত্বকালীন ছুটি কার্যকর থাকলেও অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সে আইন মানছে না। ফলে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত নারীরা। অনেককেই বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে বেকার থাকতে দেখা যায়। সরকারকে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। অন্যথায় শুধু শিক্ষিত করে নারীদের এগিয়ে নেওয়া ও সব শ্রেণির নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা যেমন সম্ভব হবে না, তেমনি পরিবার ও সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হলে সহিংসতাও কমানো যাবে না।

আমাদের জন্য আরেকটি দুঃখের বিষয় পথশিশু। পথশিশুদের মধ্যে ছেলেমেয়ে উভয়ই আছে। আজ বিশ্ব নারী দিবস। নারী দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য 'সবার জন্য সমতা'। প্রাসঙ্গিকক্রমে কথা বলতে চাই পথশিশু মেয়েদের বিষয়ে। কারণ তারাই বেশি সহিংসতার শিকার হয় এবং নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। এই মেয়েরা রাস্তায় পড়ে থাকছে, ভিক্ষা করছে কিংবা ফুল বিক্রি করছে। তাদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। অনেককে পাচার করা কিংবা অনৈতিক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। তাদের পুনর্বাসনে সরকারের সে রকম পদক্ষেপ নেই। এসব মেয়েকে নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। তাদের রাস্তা থেকে উদ্ধার করে নিরাপদ জীবনের পথ দেখিয়ে দেওয়া রাষ্ট্র ও সমাজের অবশ্য কর্তব্য। আমি মনে করি, এই শিশুদের উদ্ধারে আমাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত।

রাজনৈতিক অঙ্গনে নারী নেতৃত্বের জায়গা অনেক প্রসারিত। তবে এটা ব্যাপকভাবে হওয়া দরকার। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও নারীবান্ধব হতে হবে। নারীদের সরাসরি নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচিত করতে হবে। এতে নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেড়ে যাবে। নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত, কাজের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সমুন্নতকরণে আমাদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। আমরা চাই সব নারীই চলমান অগ্রগতির স্রোতে শামিল হোক। নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে-বাইরে সম্মান বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে দরকার সচেতনতা। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে একটি প্রচারাভিযান চালাতে হবে। একই সঙ্গে নারীকেও নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা ও নিরাপত্তা বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

আরও পড়ুন

×