ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

এক কিংবা অনেক খোন্দকার নাসির

এক কিংবা অনেক খোন্দকার নাসির

আবু সাঈদ খান

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:১৯ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৯ | ১১:১৭

অবশেষে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন পদত্যাগ করেছেন। সেখানে টানা ১২ দিন ধরে তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছিল। তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছিলেন বেশ কিছু শিক্ষকও। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, নৈতিক স্খলনসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত উপাচার্যের পদত্যাগই ছিল আন্দোলনকারীদের মূল দাবি।

খোন্দকার নাসিরউদ্দিন দাপটের সঙ্গেই ছিলেন। এক মেয়াদ শেষ করে আরেক মেয়াদ শুরু করেছিলেন। তবে শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি যৌন হয়রানির অভিযোগ ছিল। ভর্তির বিনিময়ে টাকা নেওয়ারও অভিযোগ ছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে কথা বলার ক্ষমতা কারও ছিল না। তিনি যখন-তখন বিনা নোটিশে শিক্ষার্থীদের বহিস্কার করতেন, কারও প্রতিবাদের সাহস হয়নি। কিন্তু আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও দৈনিক সান-এর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি ফাতেমা-তুজ জিনিয়াকে সাময়িক বহিস্কার ও তার সঙ্গে দুর্ব্যবহারের খবর সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বারুদে আগুন জ্বলে ওঠে।

আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউসিজি) তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত দল এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে এবং তাকে প্রত্যাহারসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিন পুলিশি প্রহরায় ক্যাম্পাস ছাড়েন এবং পরদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন আনন্দের হিল্লোল বইছে। স্বস্তি ফিরেছে উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যেও।

আন্দোলনে মুখে উপাচার্যের সরে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ইমামুল হককেও সরে যেতে হয়েছিল। সেখানেও এটি আন্দোলনকারীদের বিজয় বলে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কতটুকু উন্নতি হয়েছে?

বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসিরউদ্দিন থাকলেন না; তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর ব্যাপারে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি-না, সেটিই এখন দেখার বিষয়। তার চেয়ে বড় কথা, যিনি নতুন উপাচার্য হয়ে আসবেন, তিনি কেমন মানুষ? এখন কাদেরকে উপাচার্য করা হচ্ছে? দলীয় বিবেচনায় 'দলদাস'দের উপাচার্য করা হচ্ছে। যাদের যোগ্যতা ও সততা দুই-ই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ছাত্রনেতাদের মধ্যে কোটি টাকা বণ্টনের অভিযোগ এখন মানুষের মুখে মুখে। দেশে এমন উপাচার্যও আছেন, যিনি কর্মস্থলে থাকেন না। ঢাকায় থাকা জায়েজ করতে জেলায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজধানীতে লিয়াজোঁ অফিস খুলেছে। কেউ কেউ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। অথচ উপাচার্য একটি সার্বক্ষণিক পদ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ জন উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে। এই হলো উপাচার্যদের ভাবমূর্তি! সবাই যে অসৎ বা অযোগ্য, তা বলছি না। নিশ্চয়ই কিছু সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিও উপাচার্য পদে আসীন আছেন; তারাও সতীর্থদের কাণ্ডকারখানা দেখে হয়তো লজ্জায় মুখ ঢাকছেন।

দলের যোগ্য লোকদের উপাচার্য করলে আপত্তি ছিল না। সমস্যা হচ্ছে, যোগ্যদের আত্মমর্যাদা আছে। তারা দূরে দূরে থাকেন। আর স্তাবকরা নেতাদের পাশে ঘুরঘুর করেন। সদা তোষামোদিতে নিবেদিত থাকেন। তাই হয়তো তাদের ভাগ্য খুলে যায়, যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হয়।

উপাচার্যের মধ্যে আমরা 'আচার্য'র সন্ধান পেতে চাই। আচার্যের আভিধানিক অর্থ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা ও পাণ্ডিত্যের সমন্বয় ঘটেছে। অর্থাৎ তিনি হবেন একাধারে ন্যায়পরায়ণ ও পণ্ডিত। এমন উপাচার্যের কথা আমাদের জানা আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯০৬ থেকে ১৪ ও ২১ থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত উপাচার্য ছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তাকে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশের ভেদনীতির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। সুভাষ বসুকে 'রাসটিকেট' দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি সুভাষকে স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ার সুযোগও করে দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন স্যার এএফ রহমান, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ড. মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, ড. আবদুল মতিন চৌধুরীর মতো পণ্ডিত ও বিদগ্ধজন। তখনও উপাচার্যের পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেন পদত্যাগ করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান রাজনীতিসংশ্নিষ্ট কয়েকজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের জন্য তার ওপর চাপ দেন। তিনি চাপের কাছে মাথা নত না করে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। তিনি সম্মানিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন। আর খোন্দকার নাসিরউদ্দিন অপমান ও কলঙ্ক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন

আমরা এখন কেমন ভিসি চাই? ড. মাহমুদ হোসেনের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, না খোন্দকার নাসিরউদ্দিনের মতো আত্মমর্যাদাহীন- সেটিই আজ ভাববার বিষয়। বিদগ্ধ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন উপাচার্য পেতে হলে দলীয় সংকীর্ণতা ছাড়তে হবে। সেইসঙ্গে উপাচার্য নিয়োগের একটা নিয়ম-নীতির কথাও ভাবতে হবে।

স্বাধীনতাউত্তরকালে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ হয়েছিল। এতে গণতান্ত্রিক উপায়ে উপাচার্য নিয়োগের বিধান আছে। তবে এ আইন অনুযায়ী কেবল ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। এই চারটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি সংস্থার মতো পরিচালিত হয়। আমি বুঝতে পারি না- কেন এক দেশে দুই বিধান? '৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ (আইন) অনুযায়ী শিক্ষকরা উপাচার্যের তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচিত করবেন। সেখান থেকে আচার্য (রাষ্ট্রপতি) একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেবেন। এ প্রক্রিয়া বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে দলবাজি শুরু হয়েছে। পদ-পদবির লোভে শিক্ষকরা দলদাসে পরিণত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, দল ভারি করতে শিক্ষক পদে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। কোনো কোনো বিভাগে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমন বিভাগও আছে, এক সেমিস্টার তিনজনে ভাগ করে পড়ান। এখন দলবাজি আর তোষামোদি প্রতিযোগিতায় মত্ত হওয়ায় শিক্ষার মান নিম্নগামী।

টাইমস হায়ার এডুকেশন জরিপে বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এক হাজারের মধ্যে ভারতের ৩২টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রায় 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' হওয়ার পর্যায়ে উপনীত পাকিস্তানেরও ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আছে নেপালেরও একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্যের টিভি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তার কথা, পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একদিনের ব্যয় নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের সমান। তিনি অবশ্য ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের এক হাজারে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করলেন না। তিনি একটু খোঁজ নিলে জানতে পারতেন, হাজারে থাকা কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কম বরাদ্দে চলতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা জরুরি। নানা বিধান আছে। তবে আমার বিবেচনায় উপযুক্ত হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি বা সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন। তারাই রাষ্ট্রপতির পক্ষে প্রাথমিক সিলেকশন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বা বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগ করার সুযোগ থাকবে। এ প্রসঙ্গে দিল্লির জওয়াহেরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) এক উপাচার্যের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করতে চাই। ভদ্রলোকের নাম মনে পড়ছে না। কয়েক বছর আগে জেএনইউতে গিয়েছিলাম। সাংবাদিক-লেখক আবুল মোমেন ও শাহীন রেজা নূরও ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে ওই উপাচার্য বলছিলেন, বাইরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরিয়াল সুপারভাইজার হিসেবে তার যাওয়ার আয়োজন ঠিকঠাক। বিমানের টিকিটও কাটা হয়েছে। ব্যাগ-বোঁচকা বাঁধছেন। এমন সময় তার জেএনইউর উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব এলো। এ সম্পর্কে পূর্বাহেপ্ত নূ্যনতম আভাস-ইঙ্গিতও ছিল না। তিনি বললেন, পূজনীয় ব্যক্তিরা তাকে মনোনীত করেছেন। মান্যবরদের এ অভিপ্রায় তার পক্ষে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তিনি জেএনইউর উপাচার্য পদে যোগ দেন। অবশ্য মোদি সরকারের আমলে আগের ঐতিহ্য আর নেই। উল্টাপাল্টা ব্যাপার ঘটছে সেখানেও।

আমাদের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়- বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে পরিণত করতে আমরা কতটুকু আগ্রহী? আর তা করতে হলে যে কোনো মূল্যেই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলবাজি ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে; উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগে মেধা এবং দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে; মেধাবী ও দক্ষরাও যেন সুযোগ পেয়ে নাসিরউদ্দিন না হয়ে ওঠেন।

লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]

আরও পড়ুন

×