করোনা সংকট
মহামারির জন্য অপেক্ষা?

আবদুল মান্নান
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২০ | ১৩:২৬ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০
গত ডিসেম্বর মাস থেকে সারাবিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এই যুদ্ধে প্রতিপক্ষ কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করছে না। বিশ্বের ২১০টি দেশ একটি রহস্যজনক শত্রু বা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ছে। আর সেই প্রতিপক্ষ একটি ভাইরাস, যাকে সবাই করোনা বলে চেনেন; সেটাকে খালি চোখে দেখা যায় না। ধারণা করা হচ্ছে, এটির উৎপত্তি চীনে কিন্তু তার ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বজুড়ে। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৮ লক্ষাধিক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যু সোয়া লাখ ছাড়িয়েছে। বিশ্বের সব পরাশক্তি এই অদৃশ্য ভাইরাসের হাতে মর্মান্তিকভাবে পরাজিত। ট্রাম্প থেকে বরিস জনসন, সৌদি বাদশাহ থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট- সবাই এখন এর সামনে নতজানু হয়ে বলছেন, 'একটু কৃপা করুন হে মহাশক্তিধর।' শুরুটা যেভাবেই হোক, এখন তা দেশে দেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে। এমন মহামারি, যা বিশ্ব এর আগে কখনও দেখেনি। এই মহামারি রোধের কোনো ওষুধ বা ঝাড়-ফুঁক অথবা তাবিজ-কবচ এখনও কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি।
যেসব দেশ এই প্রাণঘাতী ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরাজিত, তারা অনেক চিন্তাভাবনা করে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পূর্বে বেঁচে থাকার একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। আর তা হচ্ছে পরস্পর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে ফেলা; কোনো এক জায়গায় জমায়েত না হওয়া, দিনে যতবার সম্ভব সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া আর এ রোগের লক্ষণ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে নির্ধারিত চিকিৎসাকেন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়া। এটি যাতে নির্বিঘ্নে হয় তার জন্য বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। দেশে দেশে বিভিন্ন সরকার এই যুদ্ধ মোকাবিলা করার জন্য সাধ্যমতো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষ ঘরে থাকার জীব নয়। সেই জন্যই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, 'থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে।' হাজার হলেও জাতীয় কবির কথা! তাকে বাঙালি অবজ্ঞা করে কীভাবে? সরকার বলল, 'ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।' কে শোনে কার কথা! অন্য দেশের অবস্থাও অনেকটা আমাদের মতো। ক'দিন আগে এক দল ব্রিটিশ পর্যটক ইস্টারের ছুটি কাটাতে একেবারে প্লেন ভাড়া করে উড়াল দিলো ফ্রান্সের সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে। তাদের দেশে মহামারির ছুটি চলছে। তার সদ্ব্যবহার তো করতে হবে। যুক্তরাজ্য এক মৃত্যুপুরী; তারা উড়াল দিলো আর এক মৃত্যুপুরীর উদ্দেশে। ফ্রান্স তাদের ফেরত পাঠাল নিজ দেশে এই বলে- 'তোমাদের দেশে মৃতদেহ সৎকার করার জন্য মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। যাও, ওখানে গিয়ে সাহায্য করো।' কে শোনে কার কথা! শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইংল্যান্ডের শুঁড়িখানায় (পাব) জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। কিছুটা ভিন্ন নাইজেরিয়া আর ফিলিপাইনে। কারণ সেখানে সরকারি হুকুম- কাউকে নির্ধারিত সময়ের বাইরে রাস্তায় দেখা গেলে গুলি করা হবে। এই পর্যন্ত তা শতভাগ কার্যকর হয়েছে।
এ তো গেল ভিন দেশের কথা। এবার মুখ ফেরাই নিজ দেশের দিকে। করোনা বাংলাদেশে এসেছে একটু দেরিতে। প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। সে ইতালি থেকে এসেছিল সঙ্গে করে রোগটা। তারপর ইতালি থেকে দেশে এলো এক উড়োজাহাজ ভর্তি বাংলাদেশি গত ১৪ মার্চ। ইতালিতে কয়েক লাখ বাংলাদেশি থাকে, যাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেখানে গেছে অবৈধভাবে। তারপরও তারা দেশে নিয়মিত টাকা পাঠায়। সেই দেশে থাকলে তারা সে দেশের আইনকানুন মেনে চলে। এমনিতে আইনকানুন মেনে চলার ব্যাপারে বিদেশে বাঙালিদের একটি সুনাম আছে। তারা কর্মঠও বটে। যে মুহূর্তে তারা দেশে আসার জন্য বিমানে চড়ে; সেই মুহূর্ত থেকে তাদের মধ্যে আইনকানুন না মানার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিমানের ভেতর ধূমপান নিষেধ। একবার দুবাই থেকে দেশের পথে এক যাত্রীকে বিমানের ক্রু পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছিল। সে কী এক হুলস্থুল! ঢাকায় অবতরণ করতে তখনও এক ঘণ্টা বাকি। মালপত্র নামানোর জন্য সে কী হুড়াহুড়ি! না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ১৪ মার্চ যখন বিমানটি ইতালি থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করল, তখন ইতালিতে করোনার সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। মারা পড়ছে ডজনে ডজন। সাধারণ মানুষ বলল, ইতালি থেকে আমরা যাত্রী আনছি না; প্লেনভর্তি মৃত্যুদূত নিয়ে আসছি। সরকার বলল, হাজার হলেও আমাদের সন্তান। তাদেরকে তো দেশে ফিরতে দিতে হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান বলল, গোল্লায় যাক আমাদের সন্তান। দেশে যারা আছে তাদের তো বাঁচাতে হবে। আমাদের সরকার জানাল, যারা আসবে তাদের জন্য বিমানবন্দরের কাছে হজ ক্যাম্পে অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বুদ্ধিতে বাঙালির সঙ্গে পাল্লা দেয় কে? বিমান থেকে নামার আগেই তাদের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা হয়। একজন বাঙালি যখন বিদেশ থেকে ফেরে, তখন তাকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে পাড়াসুদ্ধ মানুষ গিয়ে হাজির হয়। ইতালিফেরত ভাইয়েরা বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাইরে অপেক্ষারত আত্মীয়স্বজনদের মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে সরকারি গাড়িতে উঠল হজ ক্যাম্পে যেতে। হায়রে, আমার কোয়ারেন্টাইন! মালপত্র করে কি করোনাভাইরাস ঢাকা আসতে কোনো পাসপোর্ট-ভিসা লাগবে? আর যারা হজ ক্যাম্পে গেল তাদের অনেকে মনে করেছিল, সেখানে তাদের জন্য তারকাখচিত হোটেলের খাবারদাবার অপেক্ষা করছে। গিয়ে দেখে, তেমন কিছু নেই। এটা একটা খালি ভবন। যাত্রীদের পরীক্ষা করার জন্য একটি চটজলদি ব্যবস্থা। তারপর তো শুরু হলো হৈচৈ। একজন তো বাংলাদেশের বাপ-মা তুলে গালাগাল শুরু করল, তাও আবার ইংরেজিতে। নীল জামা পরা সেই তরুণটার কথা নিশ্চয় পাঠকদের মনে আছে? তারপর সন্ধ্যা না হতেই সবাই বেশ আনন্দে বাড়ি ফিরল। অনেকের মতে, বাংলাদেশের এই যাত্রার সর্বনাশটা ওখান থেকেই শুরু।
তারপরের ইতিহাস তো সবার জানা। সরকার চেষ্টা করছে, তবে মনে হয় পেরে উঠছে না। তার ওপর জেঁকে বসেছে সরকারের কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বজ্ঞানহীন, অজ্ঞতাপ্রসূত উক্তি। ঘোষণা করা হলো- মসজিদে ওয়াক্তের নামাজে পাঁচজন আর জুমার নামাজে ১০ জন অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এখন কোন পাঁচজন আর কোন ১০ জন, তা বাছাই করা নিয়ে অনেক মসজিদে হানাহানি। যদি বলা হতো- মসজিদে শুধু ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমসহ অনূ্যন পাঁচজন নামাজ পড়তে পারবেন; মসজিদের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে জড়িত নন এমন সবাইকে বাড়িতে নামাজ পড়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হলো, তাহলে এত হানাহানি হতে পারত না। ক'দিন পরে অবশ্য তা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ যদি মাস্ক পরা-না পরা বা ক্রিকেট খেলা নিয়ে মারামারি করে জীবন দিতে পারে, তাহলে মসজিদে নামাজ পড়া নিয়ে হানাহানি করতে কেন পিছপা হবে?
সরকার বলল, বিনা প্রয়োজনে রাস্তায় বের হবেন না। তখন দেখা গেল লকডাউন দেখতে এক দল বের হয়ে পড়ল। আরেক দল বলল, বাসায় আর কতদিন বসে থাকা যায়! চল, গলির মোড়ের বাচ্চুর চায়ের দোকানে একটু আড্ডা মেরে আসি। সেদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, একজন ৭০-ঊর্ধ্ব মানুষ দিব্যি কোনো মাস্ক ছাড়া কাশতে কাশতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। মাঝেমধ্যে মুখে রুমাল দিয়ে গলা পরিস্কার করছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, 'চাচা, আপনি মাস্ক পরেননি কেন?' সোজা উত্তর- 'ডোন্ট আস্ক মি এনি কোয়েশ্চন। আমি লন্ডনে ছিলাম ৪৭ বছর।' পরের প্রশ্ন- 'সরকার তো ঘোষণা দিয়েছে, নিজের ও অন্যদের সুরক্ষার জন্য আপনার মাস্ক পরা দরকার।' উত্তর, 'তোমাদের হাসিনার কথায় আমি কেন মাস্ক পরব? হায়াত-মউত আল্লার হাতে।' প্রশ্নকর্তা নাছোড়বান্দা- 'সৌদি আরবেও তো এমন হুকুম জারি করা হয়েছে।' উত্তর, 'সৌদি আরবে বাদশার হুকুম। শেখ হাসিনা কি বাদশা?' ৪৭ বছর বিলেতে থাকা একজনের এই মনোভাব হলে অন্যদের আর কী দোষ?
বাংলাদেশে এখন করোনাভাইরাসজনিত রোগ তৃতীয় ধাপ অতিক্রম করেছে। এর পর চতুর্থ ধাপ মানে রাস্তাঘাটে মানুষ মরে পড়ে থাকবে, যেমনটা ইউরোপ-আমেরিকায় দেখা যাচ্ছে। বলা হয়েছিল, এই ভাইরাস বয়স্কদের বেশি আক্রমণ করে। বয়স্করা কিছুটা হলেও সচেতন। বাংলাদেশে যারা আক্রান্ত হচ্ছে বা মৃত্যুবরণ করছে, তাদের বেশিরভাগের বয়স ৪০-এর নিচে, যারা বাচ্চুর দোকানে আড্ডা মারতে মারতে চা খায়; যারা লকডাউন দেখতে দল বেঁধে বের হয়; যারা পুলিশ আর সেনাবাহিনীর সঙ্গে চোর-পুলিশ খেলে, এমনটি চলতে থাকলে মহামারি কি ঠেকানো যাবে? অনেকের মতে যাবে না। তা বুঝেই হয়তো সরকার ১৬ এপ্রিল মহামারি বা ব্যাপক আকারে করোনা রোগের সংক্রমণ রোধে ২০১৮ সালে সংক্রমণ রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন বলে সমগ্র বাংলাদেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে। বলা যেতে পারে, মহামারি ঘোষণার একটি প্রধান ধাপ। এ জন্য দেশের বেপরোয়া মানুষ কম দায়ী নয়। সত্যি সত্যি মহামারি যখন হবে তখন তো কবর খোঁড়ার বা জানাজা পড়ানোর জন্যও কাউকে পাওয়া যাবে না। কী হবে তখন? সময় থাকতে সচেতন না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় কেউ রুখতে পারবে না।
বিশ্নেষক ও গবেষক