ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

ঈদযাত্রা

দুর্ভোগই কি নিয়তি?

দুর্ভোগই কি নিয়তি?

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২ | ২৩:০৯

প্রায় প্রতিবছর ঈদে ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনার চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১২ এপ্রিল একটি দৈনিকের প্রতিবেদনের শিরোনাম, 'ভাঙা সড়ক, অপরিকল্পিত উন্নয়ন :ঈদযাত্রায় ভোগান্তির আশঙ্কা।' ওই প্রতিবেদনের গর্ভে রয়েছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলগামী ২৩টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগে বেহাল চিত্রের দশা। ঢাকার আবদুল্লাহপুর অতিক্রম করলেই শুরু গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে সংযোগ সেতু হিসেবে রয়েছে টঙ্গী সেতু। সেতুটির অবস্থা জরাজীর্ণ। তার ওপর সড়কের অবস্থাও খুব খারাপ। একদিকে সড়কের বেহাল চিত্র অন্যদিকে 'উন্নয়নযজ্ঞ'। সড়ক উন্নয়নে কাজ চলছে এবং এর ফলে সড়ক আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় ব্যক্তিগত, পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনের চাপে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে থাকে জট। এতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন সড়কের যাত্রীরা।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মানুষ দুর্ভোগে নাকাল। এই ১২ কিলোমিটারের মধ্যে তিন কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা খানাখন্দে ভরা। এ অবস্থা আজকের নয়; দীর্ঘদিনের। এই মহাসড়কে ২০১২ সালে শুরু হয়েছিল 'বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট' প্রকল্পের কাজ, যা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট সময় শেষে আরও প্রায় ছয় বছর অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭৩ শতাংশ। আমাদের উন্নয়ন কিংবা অবকাঠামোগত প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হওয়ার নজির খুব কম। বরং দফায় দফায় বাড়ে প্রকল্পের কার্যসীমার মেয়াদ, প্রকল্প ব্যয় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আরও অনেক কিছু। এসব বিষয়ে স্বয়ং সরকারপ্রধানেরও প্রশ্ন শোনা গেছে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের তাতে কিছুই যায় আসেনা। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের এই চিত্র খণ্ডিত। অখণ্ড চিত্র পর্যালোচনা করলেও বিস্ময়সূচক অনেক প্রশ্নই দাঁড়ায়।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এখনই যে দুর্ভোগচিত্র দৃশ্যমান, তা যে ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপে আরও প্রকট হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিড়ম্বনা তো শুধু পথেই নয়; পথে নামার আগে বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকিট সংগ্রহ করাও যেন যুদ্ধে নামা। সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা ও অন্য দায়িত্বশীলরা প্রতিবারই মানুষকে নির্বিঘ্ন ঈদযাত্রার অভয় দিলেও কার্যত যে এর কোনো সুফল মেলে না, তা আমাদের অভিজ্ঞতায় মূর্ত। ২৩ এপ্রিল থেকে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বাসের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। অচিরেই হয়তো আসবে লঞ্চের আগাম টিকিট বিক্রির ঘোষণাও। এও আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, কালোবাজারি-সুযোগসন্ধানী চক্র আগাম টিকিট বিক্রির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের অপতৎপরতা শুরু করে দেয়। তার সঙ্গে যোগসাজশ থাকে সরকারের নানা স্তরের অসাধু দায়িত্বশীলদেরও। সরকার ও প্রশাসনের তরফে তাদের সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ হয় বটে, কিন্তু তারা এসব থোড়াই আমলে নেয়। ২৫০ টাকার টিকিট যেমন চার-পাঁচ গুণ বেশি দিয়ে ঘরমুখোদের সংগ্রহ করার নজির আছে, আবার এই টিকিট হাতে নিয়েও ঘরে পৌঁছার অনিশ্চয়তা জিইয়ে থাকে। এমন দৃষ্টান্তও অনেক আছে, বাড়িতে গিয়ে ঈদ করবেন- এই উদ্দেশ্যে অনেকে ঢাকা থেকে রওনা হয়েও ৫ ঘণ্টার রাস্তা ১৭-১৮ ঘণ্টায়ও অতিক্রম করতে না পারার কারণে পথেই ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে।

এই জনবিড়ম্বনা, দুর্ভোগ কিংবা মানুষের বিষণ্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট যে শুধু ঈদযাত্রায়ই সৃষ্টি হয়; তা নয়। জীবনযাত্রার স্তরে স্তরে হয়রানি-ভোগান্তির অন্ত নেই। এসবই সুশাসনের অভাবের ফল। আমরা যেমন সুশাসন চাই, তেমনি সরকারের নির্বাহী প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ ব্যাপারে সজাগ-সতর্ক তা শুনতে পাই। কিন্তু একজন প্রধানমন্ত্রী তো দশভুজা নন। সবই প্রধানমন্ত্রীকেই কেন করতে হবে কিংবা দেখতে হবে? সরকারের মন্ত্রীরা রয়েছেন; বিস্তৃত প্রশাসন রয়েছে। সমন্বয়ের ভিত্তিতে দায়িত্বশীল সবাই যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে কিংবা নিজ নিজ ক্ষেত্রে নিষ্ঠ হতেন, তাহলে জনবিড়ম্বনা কিংবা নিরাপত্তাহীনতার ছায়া এত বিস্তৃত হতো না। আমরা তাদের যতটা বাগাড়ম্বর শুনি, এর বিপরীতে কাজের কাজ ততটা দেখি না।

সময়ের কাজ সময়ে না করার দৃষ্টান্তও আমাদের সামনে অনেক। এ জন্যই এত উন্নয়নযজ্ঞও জনক্ষোভের তাপ কমাতে পারে না।

ঈদে ঘরমুখো মানুষের একদিকে থাকে দুর্ঘটনার ভয়; অন্যদিকে থাকে নৌ ও সড়কপথে ডাকাতি-চাঁদাবাজির শঙ্কা। সারা বছরই কমবেশি এমনটি হয়ে থাকে। কিন্তু ঈদে এমন ঘটনা বেড়ে যায়; তাও অভিজ্ঞতায় আছে। ছদ্মবেশীদের সর্বত্র বেড়ে যায় আনাগোনা। ঈদযাত্রায় নানা রকম অঘটন মোকাবিলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবারই সংবাদমাধ্যমে সতর্ক করে দেওয়া হয়- এসব ব্যাপারে প্রস্তুতিতে যেন কোনো ছাড় দেওয়া না হয়। সরকারের দায়িত্বশীলরাও দৃশ্যত থাকেন উচ্চকণ্ঠ। কিন্তু অনেক কিছুই কতটা অসার- এর অনাকাঙ্ক্ষিত নজিরও তো আমাদের সামনে আছে। জনবিড়ম্বনা কিংবা দুর্ভোগ লাঘবে সুনির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী পরিকল্পনার অভাবের মাশুলও মানুষকে গুনতে হয় পদে পদে। পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানভিত্তিক হলে নিশ্চয় ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরা নিয়ে বছর বছর এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না।

আমাদের অনেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতা প্রায়ই কিছু না কিছু 'অমিয় বাণী' দিয়ে থাকেন। আমরা এও দেখেছি, ঈদযাত্রা বিড়ম্বনামুক্ত করতে কোনো কোনো মন্ত্রী অতীতে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজেদের আরামকে হারাম করে। মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ এর পরও অনেক ক্ষেত্রেই অদৃশ্য হয়নি। জনগণের প্রতিনিধি, সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কিংবা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ, তারা যখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন; জনকল্যাণের পরিবর্তে নিজ কল্যাণে ব্রতী হন; দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতিতে ডুবে যান, তখন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ পোহানো ছাড়া গত্যন্তর কী? এসব প্রশ্নের উত্তর জটিল নয়।

যানবাহন ও জনচাপে মাওয়া ও পাটুরিয়া ফেরিঘাটেও অতীতে যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, সেই নিরিখে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে যাতায়াতের সব মাধ্যমে সরকারের দায়িত্বশীলদের প্রস্তুতি কতটা রয়েছে? আমরা এসব ক্ষেত্রে বৈষম্য ও অন্যায্যতাও কম দেখিনি। ঈদে বাড়ি যাওয়া ও ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার ভোগান্তি যেন অনিবার্য নিয়তি হয়ে না দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করতে কথা নয় আমরা কাজ দেখতে চাই। সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি যাত্রীবাহী যানবাহনগুলোর চলাচলে বাড়তি নজর দেওয়া জরুরি। ঈদ সামনে রেখে চলাচলের অনুপযোগী যেসব বাস-লঞ্চ নামানোর হিড়িক পড়ে, তা বন্ধে এখনই নিতে হবে ব্যবস্থা। দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ এবং সড়ক-মহাসড়ক নির্বিঘ্ন করতে অবৈধ স্থাপনা ও হাটবাজার উচ্ছেদসহ বহুমুখী কার্যক্রম শুরু হোক সময়ক্ষেপণ না করে।

দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু: সাংবাদিক ও লেখক
[email protected]

আরও পড়ুন

×