রবীন্দ্রজয়ন্তী
বিশ্বশান্তি ও সামাজিক মুক্তির প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ

আহমদ রফিক
প্রকাশ: ০৭ মে ২০২২ | ১২:০০
বিশ্বশান্তির আকুতি নতুন নয়। বিশ্বশান্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা এরই মধ্যে দৃশ্যত কম উদ্যোগ-আয়োজন দেখিনি। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সত্য, সেই শান্তি এখনও অধরা। চলমান ইউক্রেন সংকট নতুন করে পুরোনো সেই বিষয়টিই সামনে এনেছে। ইউক্রেনে চলমান রুশ আগ্রাসন যে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে; এ থেকে উত্তরণে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকাইবা কী? উত্তর সুখকর নয়।
'হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব'- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ উদ্বেগ-উকণ্ঠা যেন অশান্ত বিশ্বে স্থায়ী রূপ নিতে শুরু করেছে। বিগত শতকে মনীষীদের শান্তির পক্ষে উচ্চারণ মনে হয় দাগ কাটছে না স্বার্থপর, আধিপত্য চেতনার অচলায়তনে। বিশ্বসভ্যতা, মানব-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে যুদ্ধবাদীদের মাথাব্যথা দূরে থাক; কোনো সদর্থক ভাবনা নেই। কারণ তাদের ভাবনা স্বার্থপরতা, লোভ-লালসা ঘিরে। ক্ষমতার দাপট, ক্ষমতার লড়াই আর সেই সূত্রে আধিপত্যবাদী আগ্রাসন সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির পক্ষে একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ না হলেও আঞ্চলিক যুদ্ধেও কম বর্বরতার প্রকাশ ঘটছে না। বিশ্বের পরাশক্তি, মহাশক্তিগুলোর বড় বড় খেলোয়াড় দুর্বল বা মধ্য শক্তির দেশগুলো অনেকটা অসহায় চোখে বিশ্বসংকট প্রত্যক্ষ করছে। এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিগত শতকের শান্তিবাদী মনীষীদের বাণী নতুন করে উচ্চারণ করতে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে প্রতিবাদী প্রত্যয় গড়ে তুলতে। দেশে দেশে, এমনকি পরাশক্তির দেশেও কয়েক কোটি মানুষের দৃঢ় যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদের বলিষ্ঠ প্রকাশ হয়তো শান্তির পক্ষে কার্যকর উপায় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
প্রতিবাদহীন বিশ্বমোড়লদের হিংস্রতায় উৎসাহ বাড়ায়। বিশ্বের ভবিষ্যৎ তাদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না। এমন প্রত্যয়ই প্রকাশ পেয়েছিল গত শতকে রলাঁ-রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ শান্তিবাদীর কণ্ঠে। তবু বিশ্বযুদ্ধ ঠেকানো যায়নি। কিন্তু নিরস্ত ও নিরস্ত্র করা গিয়েছিল তৎকালীন যুদ্ধবাজদের। তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়েছিল এক পর্যায়ে এসে। কিন্তু এ শতকে 'সভ্যতার সংকট' অধিকতর সংকটের মুখে। আঞ্চলিক যুদ্ধের বর্বরতা ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রতিবাদী বিশ্ব তুলনামূলক স্তব্ধই বলা চলে। অন্তত সংঘবদ্ধ বলিষ্ঠ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি; যাচ্ছে না। গত শতকের মতো বৃহত্তর বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে না। এটাই এ শতকের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা। রবীন্দ্রনাথ বিগত শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্বরতার বিরুদ্ধে এর প্রাথমিক পর্বে বিশ্বরাজনীতির অমানবিক চরিত্র বিশ্নেষণ করে লিখেছিলেন অসাধারণ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ- 'সভ্যতার সংকট'। এ প্রবন্ধ যেমন তার আত্মদর্শন ও আত্মসমালোচনার দলিল, তেমনি মানবিক বিশ্ব ও বিশ্বশান্তির পক্ষে এক বলিষ্ঠ সনদ। শুধু সভ্যতার সংকট নয়; এর আগে একাধিক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বশান্তির পক্ষে, যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ উচ্চারণ করেছেন। একের পর এক কবিতায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণই নয়, রীতিমতো অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। যেমন পশ্চিমা পরাশক্তির বিরুদ্ধে; তেমনি প্রাচ্যের আধিপত্যবাদী শক্তি জাপানের বিরুদ্ধেও।
রবীন্দ্রনাথ উগ্র জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাই যতটা তিনি স্বদেশপ্রেমী, তার তুলনায় কিছুটা বেশি মাত্রায় বিশ্বপ্রেমী। সে বিচারে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী। যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, তেমনি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। এসব ক্ষেত্রে মানবিক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ তার প্রধান প্রেরণা। এমন সব বিচারেই বোধ হয় তার স্বদেশী প্রগতিবাদীরা, এমনকি গণতন্ত্রীরা তাকে আখ্যায়িত করেছেন 'বিশ্বনাগরিক', 'বিশ্বকবি' ইত্যাদি পরিচয়ে। আসলে রবীন্দ্রনাথের মানস গড়নটিই ছিল বৈশ্বিক চরিত্রের। কেন এ বৈশিষ্ট্য- তার জবাব পাওয়া কঠিন। হতে পারে তা সহজাত। পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রবল ভ্রমণপিপাসা মিটেছে অবশ্য দেশে, অর্থাৎ উপমহাদেশের অভ্যন্তরেই। গৃহী হয়েও তিনি বৈরাগী। তার পুত্র রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের ঘরে ঘরে ঠাঁই খুঁজে ফিরেছেন 'প্রবাসী' মনের কবি হিসেবে। এ প্রবাসপ্রবণতা অধিকতর বৈরাগী চেতনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রবল রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল। তার বিশ্বভ্রমণ কিংবদন্তিসম। পৃথিবীর কম দেশই আছে যেখানে তার পদচিহ্ন পড়েনি। বিশ্বের স্বনামখ্যাত আর কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতি ভুবনের মানুষ এত বিশ্বভ্রমণ করেছেন বলে জানা যায় না। অন্তর্গত এ প্রেরণার পরিণামে রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্বসমাজ, বিশ্বরাজনীতি, বিশ্বসংস্কৃতি স্বভাবতই তার পর্যালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
আর এ সূত্রেই বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও সেই জাগরণের মূল্যবোধের প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক বোধ তাকে বুঝতে সাহায্য করেছে- জাগরণের এ মশালটি সর্বদাই যে আলোর দীপ্তি ছড়ায়, তা নয়। রাজনীতির হাতে পড়ে কখনও কখনও সে দুর্বলের ঘরে আগুন লাগানোরও সহায়ক হয়ে ওঠে। এসব বুঝে-শুনেই রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক পরিসরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, উগ্র জাতীয়তাবাদবিরোধী মার্কিনি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ছিল না একাধিক কারণে। মার্কিনি বর্ণবাদ, নিগ্রোদের প্রতি বর্বর আচরণ তার চোখে বীভৎস, অমানবিক রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছিল একইভাবে, কিংবা অধিকতর তীব্রতায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ ও সমালোচনা। আর ধারাবাহিক এ প্রতিবাদের পরিণামে জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথের আত্মদর্শন মানবিক বোধেরই জয় ঘোষণা করেছে। সে জন্য 'সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধে এমন অবিস্মরণীয় ভবিষ্যদ্বাণী সম্ভব হয়েছে :'একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন, প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।' তাই মানুষের মানবিক অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে তিনি একজন 'মহামানব'-এর আবির্ভাব কল্পনা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্র-আমলের সংকট-তাড়িত যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আধুনিক যুগে সংকট গভীরতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষে-মানুষে অবিশ্বাস, অবজ্ঞা, ঘৃণা, ব্যক্তিক-সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিসরে স্বার্থপরতা ও অমানবিকতার প্রকাশই এখন বাস্তব সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান মানবিক সংকট হলো, ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের স্বল্পতা- ব্যক্তিক, সামষ্টিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। 'এ পৃথিবী এক মানবিক বিশ্ব'- রবীন্দ্রনাথের এমন বিশ্বাস একালে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের তাড়নায় মিথ্যা প্রতিপন্ন হতে চলেছে। পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের সংঘাতে রবীন্দ্রনাথ-কথিত 'মানবিক বিশ্ব' বিপর্যস্ত। মানুষের নিরাপত্তা আজও পদে পদে বিপন্ন। 'আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস' মানুষের মন ভোলানো মধুর বাক্যে পরিণত। 'শান্তিবর্ষ' সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। 'শান্তি না থাকলে মানব উন্নতি অসম্ভব', 'গণতন্ত্র না থাকলে টেকসই উন্নয়নের চিন্তা অবাস্তব' ইত্যাদি নীতিবাক্য যেন অর্থহীন ললিত বাণীতে পরিণত। এমন এক বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বশান্তির পক্ষে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্তর্জাতিক পরিসরে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। গত শতকে এক সময় শান্তি আন্দোলন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছিল ব্যাপক পরিসরে। শান্তির পায়রাও উড়েছিল আকাশে। সেসব এখন বায়বীয় স্বপ্টেম্ন শেষ হতে চলেছে। তবু মনে হয়, বর্তমান বিশ্বে অশান্তিবাদী আঞ্চলিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে শান্তির পক্ষে আন্দোলন শুরু করা দরকার। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ শান্তিবাদী সংগঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হলে, তৎপর হলে একমাত্র তখনই বিশ্বশান্তির পক্ষে কিছুটা সুফল অর্জন সম্ভব হতে পারে।
যুদ্ধবিরোধী শান্তিবাদী রবীন্দ্রনাথের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রচনা ও ভূমিকা যথেষ্ট ঘটনাবহুল। নানামাত্রিক রচনায় তার এ ভূমিকার প্রকাশ। প্রতাপশালী, ক্ষমতাশালী শক্তির রাষ্ট্রিক বা সামাজিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বদা প্রতিবাদ জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তার ভাষায় 'প্রতাপশালীর প্রতাপের আগুন জ্বালানো হয়েছে অসংখ্য দুর্বলের রক্তের আহুতি দিয়ে।' তার বিচার-ব্যাখ্যায়, 'এ সভ্যতা ক্ষমতা দ্বারা চালিত, এতে মমতার দান অল্প। এ সভ্যতায় পৃথিবীজুড়ে মানুষের ভয়ে মানুষ প্রকম্পিত।' এ সময়ের অর্থাৎ তিরিশের দশকে লেখা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত চিঠিগুলোতেও সাম্রাজ্যবাদী হামলার বিরুদ্ধে তার চিত্তবেদনা ও রক্তক্ষরণের প্রকাশ খুবই স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের সরস তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য উল্লেখযোগ্য :'ভেবে দেখো ঐতিহাসিক বিপ্লবে কবির আলটিমেটাম আমি ইতিপূর্বেই দিয়ে দিয়েছি, ... তাঁর মেয়াদের শেষ তারিখ হয়তো বহু শতাব্দী পরে।'
রবীন্দ্রনাথ কথিত 'ঐতিহাসিক বিপ্লব' তথা বিশ্ববিপ্লব কবে শুরু হবে; কত শতাব্দী পর শুরু হবে, সেটাই গভীর চিন্তার বিষয়। অন্যদিকে, সমাজ বদল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'আরেক লড়াই সামনে রইল, ... বৈশ্যে শূদ্রে, মহাজনে মজুরে।' তা যত দূরেই হোক, ব্যক্তি মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতার অপরিহার্য টানে এবং সংঘবদ্ধভাবে সংস্কৃতি ফ্রন্ট, রাজনৈতিক ফ্রন্ট থেকে রবীন্দ্রকথিত এবং আমাদের আদর্শগত বিবেচনায় লড়াইটা তো শুরু করতে হবে বা চালিয়ে যেতে হবে। একাধারে বিশ্বশান্তি ও সামাজিক মুক্তির প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদী ভাবনা ও বক্তব্য আজ বিশ্বজনীন সমস্যার মুখে আমাদের যেন লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে। রবীন্দ্রজয়ন্তী স্মরণে এই যেন হয় আমাদের করণীয়। রবীন্দ্রনাথ হোন আমাদের প্রেরণা এবং কর্মের উৎস শক্তি।
আহমদ রফিক :রবীন্দ্র গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক
- বিষয় :
- রবীন্দ্রজয়ন্তী
- আহমদ রফিক
- রবীন্দ্রনাথ