আশুরা
সত্যের পথে অবিচল থাকার শিক্ষা

মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০
আশুরা শব্দটি আরবি আশরুন বা আশারা থেকে উদ্গত; যার আভিধানিক অর্থ- দশ, দশম বা দশমী। শব্দটি ছিল মূলত 'আশানুরা' অর্থাৎ আশুরা দিবসের মর্যাদা রক্ষার বদৌলতে আলোকোজ্জ্বল জীবনের অধিকারী। 'আশানুরা' থেকে 'নুন' বাদ দিয়ে শব্দটিকে 'আশারা' বা 'আশুরা'তে রূপান্তর করা হয়। পবিত্র আশুরার ক্ষেত্রেই সমগ্র বিশ্বে এই শব্দের বহুল ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কেননা, আশুরার ঘটনাবলি যেমন অনেক বেশি; মানব ইতিহাসে এর গুরুত্ব এবং তাৎপর্যও তেমন অপরিসীম।
পবিত্র আশুরায় সংঘটিত সব ঘটনার অবতারণা না করে আমরা এখানে 'আশুরা' শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ১০টি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, আল্লাহ পাকের বাণী- 'ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খালিফাহ'; অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব। এই বাণীর আলোকে আশুরা দিবসেই মহান স্রষ্টা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বমানবের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। বেহেশতে অবস্থান করতে দেওয়া, তওবা কবুল করা এবং ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণসহ আদম (আ.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি এ দিবসেই সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ে মহাসত্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রলয়ংকরী মহাপ্লাবন সৃষ্টি হলে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা থেকে স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসী মানুষ নুহ (আ.)-এর নৌকায় আরোহণের বদৌলতে আশুরা দিবসেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা স্পর্শ করে। তৃতীয়ত, মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আশুরা দিবসে সংঘটিত হয়। তাঁর ঘটনাবহুল জন্ম, 'খলিলুল্লাহ' তথা আল্লাহর বন্ধু অভিধায় ভূষিত এবং খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভের ঘটনা আশুরা দিবসেই ঘটেছিল। চতুর্থত, মহান আল্লাহর নির্বাচিত পয়গম্বর মুসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর খোদাবিদ্বেষী বাদশাহ ফেরাউনের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি, নিল দরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা, ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সলিলসমাধি এই আশুরা দিবসেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরম প্রভু তাঁর প্রিয় রাসুল মুসা (আ.)-এর সঙ্গে ঐতিহাসিক তুর পর্বতে কথোপকথন করেছিলেন আশুরা দিবসেই। পঞ্চমত, নবী ইদ্রিস (আ.)-কে মহান প্রভু পরম মমতায় পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে চতুর্থ আসমানে আশুরা দিবসেই তুলে নেন। ষষ্ঠত, সৌন্দর্যের আধার নবী ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ ৪০ বছর স্বীয় পিতা নবী ইয়াকুব (আ.) থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পিতা-পুত্রের মহামিলন ঘটে এই আশুরা দিবসে। সপ্তমত, ১৮ বছর টানা কঠিন কুষ্ঠ রোগ-ভোগের পর নবী হজরত আইয়ুব (আ.) নিরাময় লাভ করেন আশুরা দিবসে। অষ্টমত, সাময়িকভাবে বাদশাহি হারানো নবী হজরত সোলায়মান (আ.) আবারও মহান সত্তার অশেষ কৃপায় রাজত্ব ফিরে পান এই আশুরা দিবসে। নবমত, টানা ৪০ দিন মৎস্যের উদরে অবস্থান করে আশুরা দিবসেই মুক্তিলাভ করেন হজরত ইউনুস (আ.)। দশমত, মহীয়সী মারইয়াম তনয় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তাঁকে আশুরা দিবসেই দ্বিতীয় আসমানে তুলে নেন। ১০ জন বিখ্যাত পয়গম্বরের জীবনে সংঘটিত এসব ঘটনা ছাড়াও আশুরা দিবসে মানব ইতিহাসের আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার অবতারণা হয়েছে। তবে আজকের পৃথিবীতে পবিত্র আশুরার ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও প্রভাবের প্রধান কারণ হলো- কারবালার মর্মন্তুদ বিয়োগান্ত ঘটনা, যা আহলে বাইত তথা নবী-পরিবারের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারী এবং মহানবী (সা.)-এর কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামের মহান সত্যকে উচ্চকিত রাখতেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। কোনোমতেই ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করেননি কিংবা তার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তাই আমাদের আদর্শ পথভ্রষ্ট ইয়াজিদ নয়, বরং ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে আমাদের জন্য মহত্তম জীবনাদর্শ। 'ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ'; অর্থাৎ প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম আরও তেজোদীপ্ত, বেগবান ও পুনরুজ্জীবিত হয়- এটাই ইতিহাসের অমোঘ সত্য।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পবিত্র আশুরায় সংঘটিত সব ঘটনার অবতারণা না করে আমরা এখানে 'আশুরা' শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ১০টি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। প্রথমত, আল্লাহ পাকের বাণী- 'ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদি খালিফাহ'; অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব। এই বাণীর আলোকে আশুরা দিবসেই মহান স্রষ্টা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বমানবের আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। বেহেশতে অবস্থান করতে দেওয়া, তওবা কবুল করা এবং ধরাপৃষ্ঠে প্রেরণসহ আদম (আ.)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি এ দিবসেই সংঘটিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, হজরত নুহ (আ.)-এর সময়ে মহাসত্যে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রলয়ংকরী মহাপ্লাবন সৃষ্টি হলে সর্বব্যাপী ধ্বংসলীলা থেকে স্বল্পসংখ্যক বিশ্বাসী মানুষ নুহ (আ.)-এর নৌকায় আরোহণের বদৌলতে আশুরা দিবসেই মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ঐতিহাসিক জুদি পাহাড়ের পাদদেশে মৃত্তিকা স্পর্শ করে। তৃতীয়ত, মুসলিম মিল্লাতের অবিসংবাদিত পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই আশুরা দিবসে সংঘটিত হয়। তাঁর ঘটনাবহুল জন্ম, 'খলিলুল্লাহ' তথা আল্লাহর বন্ধু অভিধায় ভূষিত এবং খোদাদ্রোহী নমরুদের প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভের ঘটনা আশুরা দিবসেই ঘটেছিল। চতুর্থত, মহান আল্লাহর নির্বাচিত পয়গম্বর মুসা কালিমুল্লাহ (আ.)-এর খোদাবিদ্বেষী বাদশাহ ফেরাউনের নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে মুক্তি, নিল দরিয়ার মধ্য দিয়ে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা, ফেরাউন ও তার অনুসারীদের সলিলসমাধি এই আশুরা দিবসেই সম্পন্ন হয়েছিল। পরম প্রভু তাঁর প্রিয় রাসুল মুসা (আ.)-এর সঙ্গে ঐতিহাসিক তুর পর্বতে কথোপকথন করেছিলেন আশুরা দিবসেই। পঞ্চমত, নবী ইদ্রিস (আ.)-কে মহান প্রভু পরম মমতায় পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে চতুর্থ আসমানে আশুরা দিবসেই তুলে নেন। ষষ্ঠত, সৌন্দর্যের আধার নবী ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ ৪০ বছর স্বীয় পিতা নবী ইয়াকুব (আ.) থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর পিতা-পুত্রের মহামিলন ঘটে এই আশুরা দিবসে। সপ্তমত, ১৮ বছর টানা কঠিন কুষ্ঠ রোগ-ভোগের পর নবী হজরত আইয়ুব (আ.) নিরাময় লাভ করেন আশুরা দিবসে। অষ্টমত, সাময়িকভাবে বাদশাহি হারানো নবী হজরত সোলায়মান (আ.) আবারও মহান সত্তার অশেষ কৃপায় রাজত্ব ফিরে পান এই আশুরা দিবসে। নবমত, টানা ৪০ দিন মৎস্যের উদরে অবস্থান করে আশুরা দিবসেই মুক্তিলাভ করেন হজরত ইউনুস (আ.)। দশমত, মহীয়সী মারইয়াম তনয় হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্ম এবং তাঁর শত্রুদের হাত থেকে বাঁচাতে মহান আল্লাহ তাঁকে আশুরা দিবসেই দ্বিতীয় আসমানে তুলে নেন। ১০ জন বিখ্যাত পয়গম্বরের জীবনে সংঘটিত এসব ঘটনা ছাড়াও আশুরা দিবসে মানব ইতিহাসের আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনার অবতারণা হয়েছে। তবে আজকের পৃথিবীতে পবিত্র আশুরার ব্যাপ্তি, গুরুত্ব ও প্রভাবের প্রধান কারণ হলো- কারবালার মর্মন্তুদ বিয়োগান্ত ঘটনা, যা আহলে বাইত তথা নবী-পরিবারের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারী এবং মহানবী (সা.)-এর কলিজার টুকরা দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের (আ.) শাহাদাতের মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামের মহান সত্যকে উচ্চকিত রাখতেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। কোনোমতেই ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করেননি কিংবা তার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তাই আমাদের আদর্শ পথভ্রষ্ট ইয়াজিদ নয়, বরং ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে আমাদের জন্য মহত্তম জীবনাদর্শ। 'ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ'; অর্থাৎ প্রতিটি কারবালার পর ইসলাম আরও তেজোদীপ্ত, বেগবান ও পুনরুজ্জীবিত হয়- এটাই ইতিহাসের অমোঘ সত্য।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- আশুরা
- মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন