ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার : মো. তৌহিদ হোসেন

ব্যাচেলেটের সফর সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয় নয়

ব্যাচেলেটের সফর সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয় নয়

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০

অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক মো. তৌহিদ হোসেন ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের জুলাই পর্যন্ত পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ হাইকমিশন দিল্লি ও কলকাতা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর প্যারিসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮১ সালে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেন। তৌহিদ হোসেনের জন্ম ১৯৫৫ সালে, নরসিংদীতে।
সমকাল: সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
তৌহিদ হোসেন: যতটুকু শুনেছি, মিশেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সরকারের নিমন্ত্রণেই এসেছিলেন। এই সফরে তিনি বিশেষত গুম-খুন, বিষয়ে কথা বলেছেন। এটা স্বাভাবিক। কারণ দেশে গুম-খুন নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি তৈরি করে বিষয়গুলো পরিস্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন। এখন তিনি যে পদে রয়েছেন; যেভাবে কাজ করে তাঁর সংস্থা, তাতে এটা ঠিকই আছে। তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ করেননি।
সমকাল: অনেকেই বলে থাকেন, মানবাধিকার বিষয়টি রাজনৈতিক। অর্থাৎ, মানবাধিকার বিষয়টি একেক দেশে একেকভাবে আলোচিত হয়। এটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
তৌহিদ হোসেন: মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় পৃথিবীর অনেক দেশে। বলা যায়, প্রায় সব দেশেই। মূল ইস্যুটা হচ্ছে কম বা বেশি। আবার এটা সরকার নিজেই করে কিনা, কিংবা এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয় কিনা? আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে এক কৃষ্ণাঙ্গকে পুলিশ জনসক্ষেই হত্যা করল। তারপর কিন্তু সেই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে; বিচার হয়েছে। তার চাকরি চলে গেছে। এটা হলো এমন বিষয়, কোনো ঘটনা ঘটার পর তা যদি সরকারের গোচরে আসে এবং সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তাহলে তো আর কারও কোনো কিছু বলার থাকে না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আবার এমনও হয়, সরকারের যোগসাজশেই এমনটা হয়েছে। তখন তা একটা সিরিয়াস ইস্যুতে পরিণত হয়।
সমকাল: আমাদের দেশে কি এটা সিরিয়াস ইস্যুতে পরিণত হয়েছে? আমরা দেখেছি, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
তৌহিদ হোসেন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সংস্থা হিসেবে র‌্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার বলেছে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেনি। অন্যদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। র‌্যাব সেসব বন্ধে কাজ করেছে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের এখানে অনেকে চমৎকার করে কথা বলেন। তাঁরা বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। আমাদের দেশেও হয়।' এখন, এই কথা আপনি কখন বলতে পারেন? যাঁদের ওপর নির্ভরশীলতা আছে তাঁদের তো এমন কথা বলা যায় না। এটা হচ্ছে পৃথিবীর বাস্তবতা। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বলবে, আমরা সেভাবে পারব না। আবার আমাদের রপ্তানি বাজারের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। এই অভিযোগ যদি বারমুডা করত তাহলে তো আমরা আমলেই নিতাম না। কাজেই রাজনৈতিক বাস্তবতা আমলে নিয়েই যে কারও বক্তব্য বা অবস্থানকে বিচার-বিশ্নেষণ করতে হবে।
সমকাল: বিশ্বরাজনীতির বাস্তবতা প্রসঙ্গে বলি। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিবেশী ভারত সরকারকে অনুরোধ করে এসেছেন তিনি।
তৌহিদ হোসেন: এটি নিয়ে আমার দুটো কথা আছে। এক হচ্ছে, দিল্লিতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেছেন কিনা? যদি বলে থাকেন, তাহলে তাঁর উচিত হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত তো বাংলাদেশের মানুষেরই নেওয়ার কথা। ভারত কেন বাংলাদেশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে! দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, তিনি যদি দিল্লিতে এটা বলেও থাকেন, সেটি আবার পাবলিকলি এভাবে বলা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা।
সমকাল: মিশেল ব্যাচেলেটের সফরে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
তৌহিদ হোসেন: একটি বিষয়ে আমাদের ধারণা থাকা ভালো- প্রতিটি বিষয়ে সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ণয় করা ঠিক নয়। আমি যতটুকু জানি, মিশেল ব্যাচেলেটের এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। আবার তাঁর মেয়াদও শেষদিকে। তাই মেয়াদ শেষের আগে এটা তাঁর শেষদিকের সফর। তিনি যা বলার তা বলেছেন। আবার যেখানে ঘুরে দেখতে চেয়েছেন, তা ঘুরে দেখেছেন। এখন যদি তাঁর কোনো কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে বাংলাদেশ সরকার, তা করতে পারে। প্রয়োজন মনে না করলে করবে না। এখানে এটাকে কারও সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে মাপা ঠিক হবে না।
সমকাল: মিশেল ব্যাচেলেট কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু বেগবান হবে?
তৌহিদ হোসেন: মিশেল ব্যাচেলেটের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন কিংবা রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো বক্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত, তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে- এটা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারেন। কিন্তু তাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো সুবিধা বা অসুবিধা হবে না। তিনি যেটা বলেছেন- ধৈর্য ধরতে হবে; সময় লাগবে। অপেক্ষা করতে বলেছেন। যা বলেছেন, বাস্তবতার আলোকে বলেছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। বিশ্ব যদি মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে রাজি করাতে পারে, তবেই এটি সম্ভব। এখন মিয়ানমারকে সম্মত করানোর দায়িত্ব তো মিশেলের নয়। সেই দায়িত্ব বিশ্ব সম্প্রদায়ের। বিশেষ করে শক্তিধর দেশগুলোর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এখনও এমন কিছু ঘটেনি। আর যতদিন এমন কিছু না ঘটবে ততদিন এর কোনো উন্নতি হবে না।
সমকাল: বর্তমানে বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি সংকট তীব্র হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র কৌশল কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে?
তৌহিদ হোসেন: এখন যে সমস্যার কথাগুলো বলা হলো; এর একটিও সমাধান করতে পারবে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এসব খতিয়ে দেখতে পারে।
সমকাল: অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিষয়ে তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। আমরা শুনছি, জ্বালানি ইস্যু ব্যবহার করে বাংলাদেশকে কোনো কোনো ব্লকে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন: সে ক্ষেত্রে খুব সাবধানে এবং সতর্কাবস্থায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবার এটা যেন মনে না হয়- আমরা কোনো পক্ষে চলে গেছি।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ। শুভকামনা।
তৌহিদ হোসেন: সমকালকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×