সামাজিক নিরাপত্তা
অর্থনীতির নতুন ঝুঁকি জ্বালানি-দারিদ্র্য

জুলিয়া আলম
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৫:৪২
গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্যে জ্বালানির দাম ৮০ শতাংশ বাড়ানোর পর ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন বা ইউসিএলের একটি পর্যবেক্ষণ সারাবিশ্বে আলোচিত হয়। ইউসিএল ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকুইটির গবেষকরা বলেছেন, এতে যুক্তরাজ্যের ৫৫ শতাংশ পরিবারই জ্বালানি-দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে। আসছে শীতে লাখ লাখ ব্রিটিশ পরিবার ঘর গরম করতে না পারার ঝুঁকিতে পড়বে। এটিকে স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতির বড় ইস্যু হিসেবে দেখছেন যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের গবেষকরাও।
এদিকে কোপেনহেগেন স্কুল অব এনার্জি ইনফ্রাস্ট্রাকচারের (সিএসইআই) অধ্যাপক তোরাজ জামাস ও ড. মানুয়েল লোরকা সম্প্রতি দেখিয়েছেন, কোন দেশে জ্বালানির দাম ১ শতাংশ বাড়লেও সেখানে সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়।
বাংলাদেশে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে গত সপ্তাহে ৫ টাকা কমানোর পর রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসাহাসি হচ্ছে। তবে সস্তা শোরগোলে হারিয়ে গেছে জ্বালানি-দারিদ্র্য নিয়ে ভাবনার সম্ভাবনাটিও।
কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রোল ও অকটেনের রেকর্ড দাম বাড়ায় বাংলাদেশে নতুন দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি না। শেষে লিটারে পাঁচ টাকা কমানোর পরও ডিজেলে প্রায় ৪০ শতাংশ দাম বাড়ার ফলে একজন কৃষকের সেচের খরচ বাড়ায় তিনি কতটুকু দরিদ্র হবেন, হাটে ধান বা সবজি নিয়ে যাওয়া নছিমনওয়ালার জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি কতটুকু দরিদ্র হবেন, ঘাট পারাপারে ডিজেল ইঞ্জিননির্ভর নৌকাওয়ালা কিংবা পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ ধরে জীবিকা চালানো জেলেদের নৌকা চালানোর খরচ বেড়ে যাওয়ায় তিনি কতটুকু দরিদ্র হবেন- সে হিসাব আমরা করছি না।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশে রান্নাঘরের জন্য এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ডিজেলচালিত অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র্রে ভর্তুকি কমানোর অজুহাতে বিদ্যুতের দামও কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে। আমরা কি কখনও গবেষণা করেছি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কতটুকু বেড়েছে? ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশে থাকা শ্রমিকরা বাড়িওয়ালাকে বিদ্যুতের বিল দেন ঘরে ক'টি বাতি আর ইলেকট্রিক পাখা চলে, সে হিসাব করে। বিদ্যুতের দাম কখনও গড়ে ২০ শতাংশ বাড়লেও বাড়িওয়ালা প্রতিটি বাতি বা সিলিং ফ্যানের বিল বাড়িয়ে দেন ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ। কখনও কি গবেষণা হয়েছে, গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়লে বা ইলেকট্রিসিটি বিল বাড়লে তার প্রকৃত ভার শ্রমিক বা দরিদ্র মানুষের ঘাড়ে কতটুকু বাড়ে?
জ্বালানির উচ্চমূল্য এ যুগে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়িয়ে জীবনমান কমানোর সবচেয়ে বড় অনুঘটক। কারণ, আধুনিক সভ্যতার চাকাগুলো এখনও জীবাশ্ম জ্বালানির শক্তিতেই ঘোরে। সারাবিশ্বেই জ্বালানির দাম বাড়লে অর্থনীতির সব স্তরে মূল্যস্ম্ফীতির অভিঘাত আসে। খোদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক স্টাডিতে দেখানো হয়েছিল, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম ১০ শতাংশ বাড়লে সেটি একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে যে কোনো দেশের স্থানীয় মূল্যস্ম্ফীতি বাড়ায় ০.২৪ শতাংশ। বাংলাদেশে জ্বালানির দাম এবার ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এতে নিট হিসাবেই আমরা ১ দশমিক ২ শতাংশ মুদ্রাস্ম্ফীতিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। সেটি মোটেও এই হারে সীমাবদ্ধ থাকবে না, কারণ এ দেশে ডিজেলের দাম বেড়ে ট্রাক ভাড়া গড়ে কেজিতে ৫০ পয়সার কম বাড়লেও চালের দাম কেজিতে বেড়ে যায় ৫ টাকা। এই চিত্র ইতোমধ্যে দেশের গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
আরেকটি দিক হলো, জ্বালানির দাম বাড়ায় অনেক ব্যবসার টার্নওভার বাড়বে। কারণ, পণ্য ও সেবার দাম বাড়লে বিক্রেতার টার্নওভার বাড়ে। এই ছোট ছোট বৃদ্ধি জিডিপিকেও বাড়িয়ে দেবে; কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি পজিটিভ নয়। কারণ, এই প্রবৃদ্ধি হবে দাম বাড়াজনিত, জনগণের আয় বাড়াজনিত নয়।
পোশাকসহ কয়েকটি শিল্প খাতে বার্ষিক ইনফ্লেশন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইনক্রিমেন্ট আছে, যাও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশের অনেক আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিল্প খাতে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনের বার্ষিক ইনক্রিমেন্টও হয় না। এর অর্থ, ইনফ্লেশন অ্যাডজাস্ট করার মতো ইনক্রিমেন্ট না পেয়ে তাঁদের আয় উল্টো ইনফ্লেশনের রেটে কমে যায়, তারা আরও দরিদ্র হয়ে যায়।
জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে, লোডশেডিংয়ের কারণে নতুন দারিদ্র্য আর বৈষম্য বাড়লে সেটি বাংলাদেশের রাজনীতি বা সমাজের জন্য আরেক ঝুঁকি টেনে আনবে। এ বিষয়টি নিশ্চয়ই সব উৎপাদক ভাববেন না। শিল্পপতিরা ভাববেন না। তাঁদের ভাবার কথাও নয়। এটি ভাবতে হবে সমাজবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং সর্বোপরি রাজনীতিবিদদেরই।
জুলিয়া আলম: সাংবাদিক
- বিষয় :
- সামাজিক নিরাপত্তা
- জুলিয়া আলম