ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

রাজনীতি

আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করুক বিএনপি

আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করুক বিএনপি

আবদুল মান্নান

প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০

দেশে বাস্তবে রাজনৈতিক দল দুটি- আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগবিরোধী। আওয়ামী লীগবিরোধীদের মধ্যে রয়েছে- বিএনপি, জামায়াত, মুসলিম লীগ, কিছু বাম দল, এক শ্রেণির সুশীল ব্যক্তি ও পেশাজীবী। আওয়ামী লীগবিরোধীদের মধ্যে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বে এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে। সেখানে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ইন্ধন দিচ্ছে আওয়ামী লীগবিরোধী অন্যরা। বলা বাহুল্য, এখানে সরকার মানে আওয়ামী লীগ; দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল।
অপরদিকে বিএনপি এমন একটি রাজনৈতিক দল, যার জন্মই ছিল অস্বাভাবিক। কারণ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে কোনো ব্যক্তি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে- এমন ঘটনা ভারতে বা অন্য কোনো দেশেও তেমন একটা নেই। পাকিস্তানের কথা আলাদা।
'৭৫-এর মর্মান্তিক পট পরিবর্তনের কিছু দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে ক্ষমতা দখল করেন। পরবর্তীকালে এক তামাশার নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, যেখানে তিনি ছিলেন একমাত্র প্রার্থী। এর পর বিএনপি গঠন এবং রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন করে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ভোগ করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল (অব.) ওসমানী।
চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে কিছুদিন তাঁর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় ছিলেন। এক পর্যায়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৯৬ সালে মেয়াদ পূর্ণ হলেও ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি পরিস্থিতি কম ঘোলা করেননি। আবার ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্তও খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন; তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তিনি আবারও যত রকম প্রশ্নবিদ্ধ কাজ সম্ভব, সবকিছুই করেন। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (সর্বোচ্চ আদালতে ২০১০ সালে বাতিল ঘোষিত) হাতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। সেই যে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে; আজতক তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
হারানো ক্ষমতা দখলের জন্য ২০১৩, '১৪, '১৫ ও '১৮ সালে বিএনপি চেষ্টা কম করেনি। এ সময় তাদের হাতে কয়েকশ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কয়েকশ কোটি টাকার জনসম্পদে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকশ কিলোমিটার রেললাইন উপড়ানো হয়েছে। তাদের সন্ত্রাসের আগুনে পুড়েছে কয়েকশ যানবাহন আর গণপরিবহন। এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে জেল খাটছেন। আর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘমেয়াদি দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক জীবন যাপন করছেন। তিনি ইতোমধ্যে ব্রিটিশ নাগরিকত্বও নিয়েছেন। তিনি এখন বাংলাদেশের ভোটারও নন।
যে দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় গঠিত হয়েছিল; দীর্ঘদিন বেআইনি বা আইনিভাবে ক্ষমতায় ছিল; এখন প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে; সেই দল সরকারকে যে কোনোভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় যেতে চাইবে- তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।


ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। সে বছরই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে এ দেশের প্রায় সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজ অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আওয়ামী লীগ। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে তাতেও আওয়ামী লীগের ভূমিকা অনন্য। সেই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হলেও কয়েক সপ্তাহের মাথায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকার বাতিল করে দিলে তার বিরুদ্ধেও বড় ধরনের প্রতিবাদ করে আওয়ামী লীগ। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে মূলত আওয়ামী লীগ নেতাদেরই কারারুদ্ধ করেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এটিকে দেশ দ্বিখণ্ডিত করার নীল নকশা বলে অভিহিত করে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জেলে পুরে রাখে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে করা হয় 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলা। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন ১৯৬৯ সালে এসে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। এর পুরো ভাগে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগই নেতৃত্বে ছিল।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরুটা করেছিল এ দেশের ছাত্রসমাজ। পরে তাতে যোগ দিয়েছিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট আর বাম দলগুলো। তাতেও আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগছিল না। সব শেষে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যোগ দেয় ১৫ দলীয় জোট। এর পর অনিবার্যভাবে এরশাদের পতন ঘটে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে। জামায়াতও সুযোগ বুঝে চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী গোলাম আযমকে দলের আমির ঘোষণা করলে জনবিক্ষোভের সূচনা হয়। সেখান থেকে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এই ঘাতকবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। সঙ্গে বিভিন্ন প্রগতিশীল পেশাজীবী সংগঠন, সংস্কৃতিকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সংগঠন। স্বাভাবিক কারণেই এ আন্দোলনের ঘোরতর বিরোধী বিএনপি। তখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষভাবে এ অন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি একাত্তরের ঘাতকদের একটি তালিকা প্রস্তুত ও জনসমক্ষে তা প্রকাশ করে। সিদ্ধান্ত হয়- এই ঘাতকদের প্রতীকী বিচারের পর প্রকাশ্যে রায় ঘোষণা হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। দিন-ক্ষণও ঠিক হলো। এখন জনসমাগম হবে কীভাবে? শহীদ জননী শীর্ষ নেতাদের নিয়ে কবি সুফিয়া কামালের বাসায় সভা করেন। উপস্থিত একজন বলেন, এ সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র আওয়ামী লীগ। সুফিয়া কামাল শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। আওয়ামী লীগপ্রধান জানতে চান- কত মানুষ প্রয়োজন? সুফিয়া কামাল বলেন- যত বেশি পারা যায়। রায় ঘোষণার দিন হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেছিল। প্রায় সব মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
১৯৯৬ ও ২০০৬ সালে বিএনপি নানা ফন্দিফিকির করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করলে সে চেষ্টা বানচাল হয়ে যায় গণআন্দোলনে, যার পুরোভাগে আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনা। ২০১৪ ও '১৮ সালে সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে চাইলে আবারও তা ভণ্ডুল হয়ে যায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তার সহযোগী সংগঠনগুলোর দৃঢ়তায়। নেতৃত্বে ছিলেন শেখ হাসিনা।
এখন বিএনপি সরকার হটিয়ে অসাংবিধানিক পন্থায় যে ক্ষমতায় যেতে চাচ্ছে; তাদের উচিত পেছন ফিরে দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করা। না হয় আন্দোলনের নামে তারা যা করবে তাতে জানমালের ক্ষতি হবে, বাড়বে জনদুর্ভোগ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আওয়ামী লীগকেও মনে রাখতে হবে- দলে শুদ্ধি অভিযান সময়ের দাবি। কথায় বলে- আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের দিকে তাকালে তা যে কতটুকু সত্য, তার প্রমাণ অসংখ্য।
আবদুল মান্নান: বিশ্নেষক ও গবেষক

আরও পড়ুন

×