স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে অ্যাকাউন্টিং

হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতা থেকে চিহ্নিত করা হয়। হিসাবরক্ষণের প্রাথমিক বিকাশ প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, প্রাচীন মিসরীয় এবং ব্যাবিলনীয়দের মধ্যে ছিল। এটি লেখা, অর্থ গণনা এবং প্রাথমিক অডিটিং সিস্টেমের বিকাশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। রোমান সাম্রাজ্যের সময় সরকারের বিস্তারিত আর্থিক তথ্যের অ্যাক্সেস ছিল। ইতালিয়ান লুকা প্যাসিওলি, যিনি অ্যাকাউন্টিংয়ের জনক হিসেবে স্বীকৃত, তিনিই প্রথম ডাবল-অ্যান্ট্রি বুককিপিং প্রকাশ করেছিলেন। ইতালিতে এ ক্ষেত্রটি তিনিই চালু করেছিলেন।
অ্যাকাউন্টিং একটি ব্যবসা পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ এটি আপনাকে আয় ও ব্যয় ট্র্যাক এবং সংবিধিবদ্ধ সম্মতি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করে। এ ছাড়া এটি ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বিনিয়োগকারীদের ব্যবস্থাপনা এবং সরকারকে পরিমাণগত আর্থিক তথ্য সরবরাহ করতে সহায়তা করে।
অ্যাকাউন্টিং একটি পুরোনো পেশা। শতাব্দী ধরে ব্যবসায়িক লেনদেন রেকর্ড এবং বিশ্নেষণ করা হয়েছে। যাই হোক, শুধু গত ৫০ বছরে অ্যাকাউন্টিংকে অন্যান্য পেশার জন্য গুরুত্ব ও সম্মান দেওয়া হয়েছে। আজ অ্যাকাউন্টিং হলো ব্যবসার ভাষা। যে কেউ ব্যবসায়িক ক্যারিয়ারের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী; তাঁকে কিছু মাত্রায় হলেও এই ভাষাটি শিখতে ও বলতে হবে। অ্যাকাউন্টিং ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই হিসাববিজ্ঞান নীতি এমনভাবে কার্যকর করতে হবে, যাতে সব পর্যায়ে শতভাগ জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। দেশে যে দুর্নীতি হচ্ছে, তার মূল কারণ হিসাবে গরমিল। হিসাব ঠিকমতো রেকর্ড করলে দুর্নীতি অনেক কমে আসে। হিসাবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে অধিকাংশ দুর্নীতি কমে যাবে। তাই এই দিবসে স্লোগান হওয়া উচিত- 'হিসাবে স্বচ্ছ হও, দুর্নীতি কমাও'। তদুপরি ১৯৯২ সালে ইউরোপের অর্থনৈতিক একত্রকরণ এবং বিশ্বব্যাপী ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং আরও গুরুত্ব পায়। অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ ব্যবহারকারী ওইসব ব্যক্তি, যাঁরা পরিকল্পনা করেন, সংগঠিত করেন এবং কোম্পানি চালান। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যানেজমেন্ট টিমের অ্যাকাউন্টিং প্রয়োজন। হিসাববিজ্ঞান ব্যবসায়িক সিদ্ধান্তগুলো ভৌগোলিক সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে পরিচালন দক্ষতার উন্নতি পর্যন্ত করতে পারে।
একজন হিসাবরক্ষকের ভূমিকা হলো আর্থিক রেকর্ডগুলোকে দায়িত্বের সঙ্গে রিপোর্ট এবং ব্যাখ্যা করা। ছোট ব্যবসায় শুধু একজন হিসাবরক্ষক নিয়োগ করলেই চলে। বড় কোম্পানি একটি সম্পূর্ণ অ্যাকাউন্টিং বিভাগ চালু করতে পারে। অ্যাকাউন্টিং পেশার পরিসর ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে এবং ট্যাক্স পরিকল্পনা থেকে হিসাব নিরীক্ষা পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
প্রাক-আধুনিক সময় প্রবর্তনের পর থেকে অ্যাকাউন্টিং ক্ষেত্রটি নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়েছে। এটি মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁ সময়জুড়ে অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী অগ্রগতি অনুভব করবে। ১৫ শতকে একজন ইতালীয় গণিতজ্ঞের সমালোচনামূলক কাজের প্রকাশনার বার্ষিকীতে আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং দিবস পালিত হয়। ইউরোপে ১২-১৩ শতকের মধ্যে আর্থিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটে, যা অ্যাকাউন্টিং এবং এর প্রকাশের গুরুত্বকে উৎসাহিত করেছিল। লুকা প্যাসিওলি, মহান ইতালীয় গণিতবিদ ১০ নভেম্বর ১৪৯৪ সালে প্রকাশিত তাঁর চমৎকার গ্রন্থ সুমা-ডি-অ্যারিথমেটিকাতে এটিকে বইয়ের কভারের আওতায় নিয়ে আসেন। ১৯৭২ সালের ১০ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং দিবস নির্ধারিত হয়। এটি এখন বিশ্বব্যাপী অ্যাকাউন্টিং জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
অন্য সব পেশার মতো অ্যাকাউন্টিংয়েরও ইতিবাচক বিষয় বিবেচনা করতে হবে। আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং দিবসে মানুষ হিসাবরক্ষকদের গুরুত্ব এবং যে কোনো ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তাঁদের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়। এই পেশায় প্রার্থীদের আকৃষ্ট করার অসংখ্য সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রের মানুষ যাঁরা তাঁদের কর্মজীবন অনুসরণ করতে চান তাঁরা প্রতি বছর ১০ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং দিবস উদযাপন করে থাকেন। আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং দিবস ২০২২ উদযাপনের জন্য অনেক কিছুই ঘটতে পারে। হিসাবে পারদর্শী মানুষ এই পেশার গুরুত্ব সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়াতে তাঁদের দিনটির সঙ্গে সম্পর্কিত হ্যাশট্যাগগুলো ট্রেন্ড করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বন্ধু, পরিবারের সদস্য এবং সহকর্মীদের ট্যাগ করে কথা বলতে পারেন। পেশাদারদের প্রশংসা করার জন্য তাঁরা অজানা তথ্য এবং হিসাবরক্ষকদের অবদান শেয়ার করতে পারেন।
বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং অ্যাসোসিয়েশন (বিএএ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং আটটি বিভাগীয় সদরের বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক অ্যাকাউন্টিং দিবস উদযাপন করেছে। এটি সংশ্নিষ্ট ক্যাম্পাসে একটি র‌্যালিরও আয়োজন করে, যার মধ্যে বিশিষ্ট ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা জড়িত। এ ছাড়াও বিএএ ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপকদের নিয়ে একটি ওয়েবিনারের ব্যবস্থা করে। অ্যাকাউন্টিং এবং ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের একজন ফ্যাকাল্টি হিসেবে এ বিষয়ে লিখতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ