ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সাক্ষাৎকার: মো. তৌহিদ হোসেন

রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতায় রাষ্ট্রদূতরা সুযোগ পান

রাজনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতায় রাষ্ট্রদূতরা সুযোগ পান

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২২ | ১২:০০

মো. তৌহিদ হোসেন ২০০৬ থেকে ২০০৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ হাইকমিশন দিল্লি ও কলকাতা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯৮১ সালে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেন। তৌহিদ হোসেনের জন্ম ১৯৫৫ সালে, নরসিংদীর বেলাবতে।
সমকাল: সম্প্রতি বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেছেন, 'গত (জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে আমি শুনেছি। অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।' এই বক্তব্য ঘিরে দেশের রাজনীতি বেশ উত্তপ্ত। একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত হিসেবে জাপানি রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
তৌহিদ হোসেন: তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো রাষ্ট্রদূতই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু এখানে বাস্তবতা ভিন্ন। শক্তিধর দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত, যাঁরা এখানে রয়েছেন, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে যাচ্ছেন। কোনো নির্দিষ্ট দল নয়। এটি যখন যে বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরাই বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্রদূতদের কাছে ধরনা দিয়ে আসছেন। এটি ৩০ বছর ধরে হয়ে আসছে। এবারে জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। কিন্তু তারাই যখন বিরোধী দলে ছিল, একই কাজ করেছে। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার- এসব নিয়ে সংশ্নিষ্ট রাষ্ট্রদূতদের দেশের অবস্থান আছে। তাঁরা সে অনুযায়ী বক্তব্য রাখছেন। আমার মনে হয়, এটি অব্যাহত থাকবে। এটি বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে না।
সমকাল: জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বিবৃতি দিয়েছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
তৌহিদ হোসেন: রাষ্ট্রদূত বলেছেন, তিনি শুনেছেন, পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রেখেছে। জবাবে পুলিশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটি তারা তাদের জায়গা থেকে করেছে। কিন্তু এই প্রতিবাদের ভাষাটি আমার কাছে সঠিক মনে হয়নি। ২০১৮-এর নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে- এটির সার্টিফিকেট দেওয়া পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্ব নয়। বলতে পারতেন, তারা কেবল নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। এটুকু বললেই যথেষ্ট হতো বলে আমি মনে করি। নির্বাচন কেমন হয়েছে, এটি বলার দায়িত্ব পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের নয়।
সমকাল: আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ভারতে গিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য চেয়েছেন। এ জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজ দল এবং বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
তৌহিদ হোসেন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছিলেন। এই বক্তব্য নিয়ে ইতোমধ্যে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আমি মনে করি, যদি তিনি ভারতে গিয়ে এমন অনুরোধ করেও থাকেন, তবে তা জনসমক্ষে বলা ঠিক হয়নি। আমরা তো এটা জানি, আমাদের রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে বা রাষ্ট্রদূতদের কাছে নানা বিষয়ে কথা বলে থাকেন; অভিযোগ জানিয়ে থাকেন। একটি দেশের শাসনক্ষমতায় কারা থাকবেন তা নির্ধারিত হওয়ার কথা নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে। এভাবে কথা বললে নাগরিকের ভোটাধিকারের প্রতি সম্মান থাকে না।
সমকাল: আপনি নিজেও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশ এবং অন্য কোনো দেশের মধ্যে মিল-অমিল কতটুকু দেখেছেন?
তৌহিদ হোসেন: প্রতিটি দেশ ইউনিক। ধরা যাক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের এখন যিনি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তিনি গত জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকরা যেভাবে ক্যাপিটল হিলে হামলা করল, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না। আমরা তো আমেরিকার ব্যাপারে কথা বলতে পারব না। বিষয়টি হচ্ছে, যারা শক্তিমান তারাই অন্যদের ব্যাপারে বলতে পারে। যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, যেমন আমরা সেভাবে মন্তব্য করতে পারব না।
সমকাল: আমাদের দেশে এর আগেও দেখেছি, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্রদূতরা কথা বলেন।
তৌহিদ হোসেন: আমাদের এখানে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে, সে কারণে তাঁরা কথা বলেন। আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে দুর্বলতা, সে কারণে তাঁরা সুযোগটি পেয়ে থাকেন। সেসব কারণে তাঁরা নির্বাচনের সময় এগিয়ে এলে উচ্চকণ্ঠ হয়ে থাকেন। তবে সহজ করে বলতে পারি, ধরা যাক ২০০১ ও ২০০৮-এর নির্বাচন নিয়ে তাঁরা কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। কারণ তখন তুলনামূলক ভালো নির্বাচন হয়েছিল। ২০০১-এর নির্বাচন নিয়ে কথা না হলেও নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা নিয়ে কথা হয়েছিল। এখন তাঁরা ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। কেন বলছেন? কারণ সেই নির্বাচনটি মানসম্মত হয়নি। সবাই মোটামুটি জানেন, সেই নির্বাচনে রাতের বেলা ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছিল। এমন কাজ হয়েছিল বলেই অন্যরা এই নির্বাচন নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। যদি আমরা নির্বাচনটি ভালোভাবে করতে পারতাম, তাহলে কেউ কথা বলার সুযোগ পেতেন না। সুযোগ তো আমরাই তৈরি করে দিয়েছি। এখন তাঁরা (জাপানি রাষ্ট্রদূতসহ অনেকে) বলতে চাইছেন, এমন নির্বাচন আর দেখতে চান না।
সমকাল: জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস আমরা দেখতে পাচ্ছি। এক পক্ষ এটিকে লুফে নিয়েছে; অপর পক্ষ প্রত্যাখ্যান করছে। প্রতিবাদ জানিয়েছে...
তৌহিদ হোসেন: এখন যাঁরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন, এটিও রুটিন প্রতিবাদ। এতে কিছু ফল আসবে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাইবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরদিন জাপানি রাষ্ট্রদূত নাওকি পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন জাপান সফর নিয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- কথা হয়েছে। কোনটা সত্যি, আমরা তা জানতে পারব না। আমরা স্মরণ করতে পারি, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে কয়েক দিন আগে তলব করা হয়েছিল। মিয়ানমার রাষ্ট্রদূত দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সীমান্তে একই ঘটনা আবারও ঘটল। বাংলাদেশ আবারও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। এখন এসব হচ্ছে রুটিন প্রতিবাদ, রুটিন তলব।
সমকাল: রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা নির্বাচনে কতটা প্রভাব রাখতে পারে? কীভাবে প্রভাবিত করে?
তৌহিদ হোসেন: অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, রাষ্ট্রদূতদের তৎপরতা খুব একটা কাজে আসে না। শেষ পর্যন্ত সরকারের সদিচ্ছার প্রতিফলনই নির্বাচনে প্রভাব রাখে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ এবং বহির্দেশের চাপ যদি থাকে এবং সরকার যদি সেটিকে এড়াতে না পারে, তাহলে নির্বাচনে প্রভাব পড়ে। তবে ২০১৪-এর নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ দেখা গেছে। এ জন্য কিন্তু ভারতকে দোষারোপ করা যাবে না। দোষ আমাদের নিজেদেরই। আমরা নিজেদের ঘর সামলাতে পারি না বলেই তাদের শরণাপন্ন হতে হয়। আমাদের এখানে যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক পক্ষ রয়েছে, তারা যদি বলে- নির্বাচনটি নিরপেক্ষ হবে; যার যার ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। যে ভোটে জয়ী হবে, তা মেনে নিতে হবে; তাহলে নির্বাচন নিয়ে আর নালিশ করার দরকার হবে না।
সমকাল: ২০১৪-এর নির্বাচনে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কথা বলছিলেন। সেটি কেমন ছিল?
তৌহিদ হোসেন: সেই নির্বাচনের সময় আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় হাইকমিশনার হিসেবে ছিলাম। নির্বাচনের পরে দেশে ফিরে এসেছিলাম। সেই নির্বাচন নিয়ে যেটি শুনেছিলাম- নির্বাচনে দুটি জিনিস ঘটেছে। একটি হলো, বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। মূল বিরোধী দল বিএনপিও অংশ নেয়নি। জানা যায়, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের পরামর্শে সেই সময়ে জাতীয় পার্টির এরশাদকে সিএমএইচে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে সব যোগাযোগ স্থগিত করে দেওয়া হয়। জাতীয় পার্টির এক পক্ষ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে সেই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
সমকাল: ইদানীং দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূতরা একত্র হচ্ছেন। আপনারা সম্মিলিত হয়ে কিছু করার চেষ্টা করছেন কিনা- এমন একটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তৌহিদ হোসেন: এমন কিছু আমার জানা নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নই। আর আমি মনে করি, যাঁরা অবসরপ্রাপ্ত তাঁরা যদি সরকারকে কোনো পরামর্শ দিতে চান বা দেওয়ার সুযোগ পান, তাহলে দিতে পারেন। কিন্তু সরকার যদি তা গ্রহণ না করে তাহলে তো কিছু করার নেই।
সমকাল: একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবে আপনার পরামর্শ কী? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখন কেমন হওয়া উচিত?
তৌহিদ হোসেন: পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত- এই তাত্ত্বিক আলোচনা এখানে করা সম্ভব নয় বলে মনে করি। তবে বাংলাদেশের সামনে যে বাস্তবতা, সেখানে বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন সময়। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী যে মেরূকরণ ঘটছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য ভারত-চীন উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আবার এ দুটি দেশ পরস্পর শক্ত বিরোধী অবস্থানে রয়েছে। এমন একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত নিজের স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব রক্ষিত থাকবে- এমন ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করা।
সমকাল: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তৌহিদ হোসেন: সমকালকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন

×