ইউরোপের চিঠি
শামসুল বারির 'কাজলি মডেল' স্কুল

দাউদ হায়দার
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৫:১০
বার্লিনের যে মহল্লায় দুই যুগের বেশি বাস, সামনে-পেছনে, ডানে-বামে বহু বাড়ির কচিকাঁচা চেনা। তাদের মা-বাবাও। অনেকের সঙ্গে সখ্য ভাব।
মহল্লার দুই ফার্লঙ্গের মধ্যে ছয়টি কিন্ডারগার্টেন। তিনটি হাইস্কুল। ছয়টির মধ্যে চারটি 'কিটাক্রিপে'। কিন্ডারগার্টেনের সংক্ষিপ্ত 'কিটা'। সঙ্গে 'ক্রিপে' যোগ। মানেও বদল। কিটাক্রিপে মূলত ছয় থেকে দশ মাসের কচি তথা শিশুদের। একই পাঠশালায় আলাদা ঘর। শিশুদের দেখভালে একাধিক বুয়া।
সন্তানের মা-বাবা চাকরিজীবী। মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসের বেশি নয়। বাধ্য হয়েই কিটাক্রিপেয় রাখতে হয়।
কিটাক্রিপেসহ কিন্ডারগার্টেনে কচিকাঁচা এঘরে-ওঘরে বছর পাঁচেক। একই পাঠশালায়। ছয় মাসের কচির বয়স বাড়ে। এক বছরের মধ্যেই শেখানো হয় কী করে জামাকাপড় পরবে। ছুরি, কাঁটাচামচ দিয়ে খাবে। জোরজবরদস্তি, শাসনত্রাসনে লেখাপড়ার বালাই নেই। পঠনপাঠন ভিন্ন কায়দায়। গুরুমশাই/মহাশয়া শিশুতোষ রঙিন বই (বইতে ছবি। টেকস্ট সামান্য) সামনে রেখে বইয়ের গল্প বলেন। ছবি দেখান। বোর্ডে ছবি আঁকেন লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-শাদাকালো চকে। পেন্সিলে। খোলা বাক্সে চক। পেন্সিল। কচিরা চক, পেন্সিল নিয়ে যে যার মতো ছবি আঁকে। গুরুকে বলতে হয় 'খুব ভালো, খুব ভালো।' কচিরা উৎসাহে টগবগে। দেড়-দুই বছরের কচিদের গুরু বলেন, 'কাল তুমি গল্প বলবে।' পরদিন গল্প, কবিতা, ছড়া বলার প্রতিযোগিতা। কে আগে বলবে।
স্কুলের আশপাশেই পার্ক বা ছোট মাঠ। খেলার জায়গা। কচিরা দলবেঁধে একসঙ্গে। খেলাধুলোয় স্বতঃস্ম্ফূর্ত। দোলনা, নাগরদোলায় চড়ছে। পড়ছে। কান্নাকাটি করছে। বুয়া, গুরুর মুখে 'আহা, আহা, হু' নেই। সবই স্বাভাবিক। অন্য কচিরা খেলাধুলোয় মশগুল দেখে কান্নাকাটির কচি ব্যথা ভুলে সহখেলোয়াড়। ঝগড়া, মারপিটও করে। পরক্ষণেই মিলমহব্বত। কিছুই হয়নি যেন। বন্ধুতা। একসঙ্গে নানা যাওয়া। বনজঙ্গলে। প্রকৃতি-পরিবেশ চেনানো। জানানো। হরেক মজায়, আনন্দে বিভোর।
পাঠশালা ছুটি থাকলে মা-বাবার কথা :'জ্বালিয়ে মারে। পাঠশালায় যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো করবে। দলবেঁধে কোথাও যাবে।'
ঠিক এইটেই শামসুল বারির 'কাজলি মডেল' (স্কুল। বানান লেখেন 'কাজলী')।
মডেল শুরুর আগে 'রিইবি' (রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠা। উদ্দেশ্য হতদরিদ্র, শিক্ষাবঞ্চিত, দলিত, হরিজন, নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী নিয়ে অসাম্প্রদায়িক সমাজ, দেশ গঠন।
শুরুতে ডাচ সরকারের আর্থিক সহায়তা। কিন্তু কোনো এনজিও নয়।
বাইশ বছর আগে (২০০০ সালে) রিইবির কার্যক্রম শুরু। যোগ দেন (পরামর্শক। পরেও অনেকে) ড. হামিদা হোসেন। প্রফেসর মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। ডক্টর রওনক জাহান। মনোয়ারুল ইসলাম। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা। ড. মইনুল ইসলাম। প্রফেসর এমএম আকাশ। প্রফেসর গীতিআরা নাসরীন। সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
লক্ষণীয়, প্রত্যেকে শিক্ষাসংস্কৃতির। বুদ্ধিজীবী। রাজনীতিক নন। রাজনৈতিক মস্তান, নেতা, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, আইনজীবী নেই।
বাংলাদেশে- উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, গঞ্জে, গ্রামে 'কাজলি মডেল' স্কুল। লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী। কাজলি মডেল শিক্ষা ভারতের নানা রাজ্যেও বিস্তৃত। মডেল কীভাবে। জানিয়েছেন শামসুল।
গ্রামের দরিদ্র কচিকাঁচা স্কুলে যাবে। স্কুল কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকার বাড়ি। হোক ছোট ঘর। শুরুতে পড়ানোর চেয়ে নানা উপকরণ। খেলাধুলো। কচিকাঁচার সম্মিলন। একাত্মতা। জাতপাতহীন বন্ধুতা। কেবল ভারতেই নয়, এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশে বিস্তৃত।
শামসুলের এই বিশাল কর্মকাণ্ড আমরা কি খুব জানি? নিজে প্রচারিত করেন না। নেপথ্যে। নিভৃতচারী। গোপন কথাটি রবে না গোপনে। নিভৃতচারীর কর্মকাণ্ড জেনেছেন অনেকেই। বিদেশেও। আমেরিকা-ইউরোপের বিখ্যাত কাপড় বিক্রেতা সংস্থা 'সিঅ্যান্ডএ' বিনা সুদে আর্থিক সাহায্যে আগুয়ান।
খোঁজ নিয়ে জানলুম 'হ্যের (মিস্টার) শামসুল বারির কাজলি মডেল প্রভূত শিক্ষণীয়।'
কাজলি মডেল স্কুলে নিয়ম, কচিরা আসবে। পড়বে। বেতনছাড়া। খেলাধুলা করবে। কেউ সাহায্য করলে করবে। বহু গ্রামবাসী সাহায্যে এগিয়ে। মাসে দশ থেকে দুইশ টাকাও দিতে অকৃপণ।
প্রাথমিক পরীক্ষায় ঈর্ষণীয় রেজাল্ট। গরিবের ঘর থেকেও খাওয়া আসছে। কচিকাঁচা অভুক্ত নয়।
কাজলি মডেল ইতোমধ্যেই গ্রামগ্রামান্তরে, দাবি উঠছে আরও কাজলি মডেলের। বিদেশি বহু সংস্থা, এনজিও যুক্ত হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা।
শামসুলের গোঁ, 'দূর হটো। আমাদের সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্য, স্বেচ্ছাসেবী, শিক্ষক-শিক্ষিকার বদান্যই যথেষ্ট। কেউ আর্থিক সহায়তা করলে বিনাশর্তে।' অনেকেই রাজি।
শামসুলের কাজলি মডেল উত্তরবঙ্গেই সীমিত কেন?
প্রশ্নের উত্তর :'অঞ্চল থেকে প্রসারিত হবে। আমরা উদ্যোগী।'
দাউদ হায়দার: কবি
- বিষয় :
- ইউরোপের চিঠি
- দাউদ হায়দার