রাজনীতি
রাষ্ট্র মেরামতে নতুন কারিগরের আবির্ভাব?

আবদুল মান্নান
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০
বিএনপি এখন অনেকটা গভীর সমুদ্রে নাবিক ছাড়া জাহাজের মতো চলছে বললে ভুল হবে না। বছর দুই আগে হঠাৎ মনে হলো, তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়া দরকার। এ জন্য তারা বিভিন্ন রকমের সভা-সমাবেশ শুরু করে। সঙ্গে পায় নতুন প্রজন্মের কিছু পাকিস্তানপন্থি বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়া। তাদের সেই কর্মসূচি শুরু হয় এক দফা দিয়ে- শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না; হতে হবে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যা বাতিল করা দিয়েছেন, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। একই সঙ্গে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। তারপর যোগ হলো, নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে। গত ১০ ডিসেম্বর দলটি ঢাকার গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করে ১০ দফা ঘোষণা করল। এর আগে বিএনপির এক বড় নেতা আমান উল্লাহ আমান ঘোষণা দিয়েছিলেন- ১০ তারিখের পর খালেদা জিয়া দেশ পরিচালনা করবেন আর তারেক জিয়া দেশে ফিরে দেশের দায়িত্ব নেবেন। ১০ তারিখের সমাবেশে অনেকেই এসেছিলেন খালেদা জিয়া আর তারেক রহমানকে দেখার জন্য। সেদিন সেই সমাবেশের বেশিরভাগই হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন।
সাত দিন পার না হতেই একটি বিলাসী হোটেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঘোষণা করলেন নতুন ২৭ দফা। ২৭ দফার নাম হলো- 'রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা'। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো কিছু ভেঙে গেলে বা অচল হয়ে পড়লে তা মেরামত করতে হয়। বাংলাদেশ কখন ভাঙল? হাঁ, ভেঙেছিল; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর।
জিয়া ক্ষমতায় এসে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে বানাতে চাইলেন একটি মিনি পাকিস্তান। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে প্রস্তাবনার শুরুতে 'জাতির মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের' অংশটি বাতিল করে তাতে প্রতিস্থাপন করলেন 'জাতির স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের'। এক ধাক্কায় জিয়া পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরে বাঙালি মুক্তির জন্য যে সংগ্রাম করেছে, তা বাতিল করে দিলেন। খালেদা জিয়ার আমলে প্রস্তাবনাটি সংবিধানের শেষে সংযোজনী হিসেবে চলে গেল। অথচ এই প্রস্তাবনা পড়েই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার শপথ নিয়েছিল আর বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই প্রস্তাবনা দিয়েই দেশ পরিচালিত হয়েছে। এই জিয়াই সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে একাত্তরের ঘাতক জামায়াত ও মুসলিম লীগের মতো দলগুলোকে দেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এই জেনারেল জিয়াই সংবিধানে ইনডেমনিটি আইন সংযোজন করে জাতির পিতার ঘাতকদের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। বিএনপির ২৭ দফা পড়লে মনে হয়, এসব ভুলে গিয়ে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে দিতে তারা উদ্যোগ নেবে। এ যেন ধর্ষক আর ধর্ষিতাকে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে বলা।
২৭ দফা অনুসারে বাংলাদেশকে নাকি রংধনু দেশ বা রেইনবো নেশন বানাবে বিএনপি। উর্বর মস্তিস্কের উর্বর চিন্তা বটে। এই শব্দের জনক বলা যেতে পারে একসময় বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেলজয়ী বিশপ ডেসমন্ড টুটুকে। তিনি বলেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন শেষ হলে দেশে সবাই নিরাপদে বসবাস করতে পারবে; দেশটা হবে রংধনুর মতো। সব মত-পথ ও বর্ণের মানুষ একসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করবে দক্ষিণ আফ্রিকা বর্ণবাদমুক্ত হলে। দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ডেসমন্ড টুটুর এই মতবাদ গ্রহণ করেন। এই দেশটিতে ১১টি জাতীয় ভাষা; চারটি উপজাতি; আছে তিনটি রাজধানী। এত বছর পর দেশটি আইনশৃঙ্খলার সূচকে ১৩৭তম। এর চেয়ে খারাপ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আছে আরও ছয়টি দেশে। গড়ে প্রতিদিন ৫৭ জন মানুষ দেশটিতে খুন হয়। বিএনপি কি বাংলাদেশকে এই রকম রংধনু দেশ বানাতে চায়? বিএনপি কি এমন দেশ চায়, যেখানে খুনির দল জামায়াত, তালেবানি মন্ত্রে দীক্ষিত হেফাজত, জাতির পিতাকে হত্যা করার পর যে জেনারেল ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাঁর দল, আওয়ামী লীগ পরিত্যক্ত ব্যক্তির নেতৃত্বাধীন ওয়ানম্যান পার্টি, স্বামী-স্ত্রী পার্টি, হোন্ডা পার্টির মতো দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক মেলা বসবে? স্বপ্নবিলাস আর কাকে বলে!
২৭ দফার অন্যতম- আওয়ামী লীগের আমলে করা সংবিধানের সব সংশোধনী বাতিল। তাহলে কি আবার ইনডেমনিটি আইন ফিরে আসবে বা 'ধর্মনিরপেক্ষতা' বাতিল করা হবে? ২ নম্বর দফায় ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর মানে কি আগে যা ঘটেছে, সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে হবে? ভুলে যেতে হবে এই দেশে পঁচাত্তরে একটি হত্যাকাণ্ড হয়েছিল বা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছিল?
১৩ নম্বর দফায় আছে গত ১৫ বছরের দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে। তার আগের দুর্নীতির কী হবে? খালেদা জিয়ার পুত্র কোকোর পাচার হওয়া ২২ কোটি ডলার দেশে ফিরিয়ে আনার ঘটনা? যিনি ২৭ দফা পড়ে শোনালেন, তাঁর ও তাঁর পুত্রের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে ৪৮ লাখ টাকার দুর্নীতির মামলা চলছে (ডেইলি স্টার, জুলাই ৩০, ২০১৮), তা কি চলবে? লন্ডনের ব্যাংকে তাঁর ৮ লাখ ৮ হাজার ৫৩৮ পাউন্ড ফ্রিজ করা আছে। সন্দেহ- এই অর্থ বৈধ উপায়ে লন্ডন যায়নি (সমকাল, ৩০ নভেম্বর)। তারেক রহমানের আছে ৫৯ হাজার ৩৪১ পাউন্ড (সূত্র একই)। তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। সেগুলোর কী হবে? আর সংবিধান মেরামত? তা করার দায়িত্ব তো জাতীয় সংসদের; কোনো জেনারেলের ফরমানবলে নয়। ক্ষমতা দখল করে কোনো জেনারেল তা করতে চাইলে নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড। সংবিধান তা-ই বলছে।
প্রথমে ১০ দফা, তারপর ২৭ দফা; আপাতত মোট ৩৭ দফা। সামনের দিনগুলোয় যদি এই রকম দফার তালিকায় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব আসে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিএনপি মহাসচিব তো বলেই দিয়েছেন- বর্তমানের চেয়ে পাকিস্তান আমল ভালো ছিল। সব দেখে-শুনে মনে হয়, বিএনপি এখন ঘুমের ঘোরে হাঁটছে।
সব পাঠককে বড়দিন ও খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
আবদুল মান্নান: বিশ্নেষক ও গবেষক
- বিষয় :
- রাজনীতি
- আবদুল মান্নান