ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

জ্বালানি খাত

বিইআরসি কি অচল হয়ে গেল?

বিইআরসি কি অচল হয়ে গেল?

সবুজ ইউনুস

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৯:১৯

শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বাড়ল। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বুধবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তবে সিএনজি, বাসাবাড়ি ও সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়েনি। (সমকাল অনলাইন, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৩)। এর আগে গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। দুই ক্ষেত্রেই বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াল সরকার।

ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে নির্ধারণের জন্য দাতা গোষ্ঠীর পরামর্শে ২০০৩ সালে এক আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি গঠিত হয়। ২০০৪ সালে স্বাধীন এই কমিশন যাত্রা শুরু করে। এর পর এই কমিশনের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছিল। এর আগে সরকারের নির্বাহী আদেশে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এসব পণ্যের দাম সমন্বয় করা হতো, যেখানে স্বচ্ছতার অভাব ছিল। বহু বছর পর এই মাসে এসে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো।

এখন প্রশ্ন, তাহলে বিইআরসি কি অচল হয়ে গেল? তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ নিয়ে সরকার সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। সেখানে বলা হয়, জরুরি কোনো পরিস্থিতিতে সরকার এসব পণ্যের দাম নির্বাহী আদেশে ঘোষণা করতে পারবে। এই অধ্যাদেশবলেই এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা পেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণ করবে বিইআরসি। তবে সরকার প্রয়োজনে, জরুরি কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে কখনও কখনও এসব পণ্যের দাম বাড়াতে বা কমাতে পারবে। অর্থাৎ বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে।

এই ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়োজন কেন হলো? এর মূল কারণ আইএমএফ তথা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের 'পরামর্শ'। সরকার আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে যাচ্ছে। আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এখন ঢাকা সফর করছে। ইতোমধ্যে এই ঋণের প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। আগামী ৩০ জানুয়ারি এই সংস্থার পর্ষদ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন হবে। অনুমোদন হলে সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এই সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পাবে বাংলাদেশ। তার আগেই আইএমএফের আস্থা অর্জন করতে হবে।

আইএমফের এই ঋণ পেতে হলে তাদের কিছু পরামর্শ অবশ্যই শুনতে হবে। সেই পরামর্শের অন্যতম হলো, বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানো। বিশেষ করে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। যদিও আইএমএফ বা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করতে চায় না- এ রকম শর্ত বা পরামর্শ রয়েছে। তবে এটি অনুমান করা কঠিন নয়, আইএমএফের পরামর্শেই তড়িঘড়ি করে এসব পণ্যের দাম নির্বাহী আদেশে  বাড়ানো হচ্ছে।

আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর এখতিয়ারও বিইআরসির। কিন্তু বিইআরসিকে কখনোই তেলের দাম বাড়ানো বা কমানোর সুযোগ দেয়নি সরকার। সরকার নির্বাহী আদেশে এই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, জ্বালানি তেল একটি স্পর্শকাতর পণ্য। আকস্মিকভাবে এ পণ্যের দাম বাড়াতে হয়। সাধারণত প্রজ্ঞাপন জারি করে রাত ১২টা থেকে বর্ধিত মূল্য কার্যকর করা হয়, যাতে পাম্প মালিকরা আগে থেকে জানতে না পারেন। এটি আগে থেকে জানাজানি হলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। পাম্প ব্যবসায়ীরা অবৈধ মজুত করতে পারেন। সারাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্য নিয়ে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এ জন্য এই পণ্যের দাম সরকার নিজ উদ্যোগে বাড়িয়ে থাকে। বিইআরসিকে পণ্যটির দাম নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হয় না।


বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যা নেই। এ জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের আগে ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিয়ে বিইআরসি গণশুনানি করে থাকে। সাধারণত তিন মাসের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর একটি যৌক্তিক দাম ঘোষণা করা হয়। এসব পণ্যের বিল পরিশোধ করা হয়ে থাকে মাস শেষে। ফলে এখানে কোনো সমস্যা হয় না।

বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে। কারণ দাম বৃদ্ধির আবেদন এলে বিইআরসি সেটা নিয়ে এক প্রকার গবেষণা করে। দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা বিশ্নেষণ করা হয়। এর পর উভয় পক্ষে শুনানি করা হয়। ভোক্তাদের বক্তব্য শোনা হয়। পাশাপাশি দাম বাড়ানোর আবেদনকারী কোম্পানির বক্তব্যও শোনা হয়। এরপর আধা বিচারিক এই সংস্থা বিইআরসি যতটুকু যৌক্তিক মনে হয়, সেই পরিমাণ দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। ফলে এখানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। কোম্পানি অযৌক্তিক দাম বাড়ানোর আবেদন করলে তা গ্রহণ করা হয় না। এখানে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা হয়, যাতে সাধারণ ভোক্তা ও কোম্পানি উভয়েই বড় ক্ষতির মুখে না পড়ে। কিন্তু সরকার অধ্যাদেশ জারি করে সেই ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে গেল। দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতাও সরকারকে আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। দাম বাড়ানোর এটি কোনো ভালো প্রক্রিয়া নয়।

যেমন গত ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের যে দাম বাড়ানো হলো, সেখানে তাড়াহুড়োর দরকার ছিল না। বিশেষত বিইআরসি দাম বাড়ানোর বিষয়ে গণশুনানি করেছিল। ধারণা করা হয়েছিল, বিইআরসি দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেবে। কিন্তু তড়িঘড়ি করে সরকারই দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিল। এমন কোনো জরুরি পরিস্থিতি ছিল না যে, সরকারকেই নির্বাহী আদেশে এ ঘোষণা দিতে হবে।
এতে বিইআরসির ক্ষমতা ব্যাপকভাবে খর্ব করা হলো। ভোক্তা শ্রেণির অধিকার সুরক্ষার বিষয়ও কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।

গত সপ্তাহে সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তাঁর ব্যাখ্যাটা এ রকম যে, বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হলো। দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শেই এই বিইআরসি গঠিত হয়েছিল। আরেক ঋণ বিক্রেতা সংস্থার পরামর্শ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে তড়িঘড়ি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলো। জাতীয় নির্বাচনের আর এক বছর বাকি। সাধারণত এ সময়ে কোনো সরকার জনগণকে কষ্ট দিতে চায় না। অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না। কারণ জনগণকে তুষ্ট করে, তাদের ভোট নিয়েই ক্ষমতায় আসতে হবে। কিন্তু সবকিছু জেনেশুনে সরকারকে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়েছে। গ্যাসের দামও বাড়নো হলো একই কারণে। বিদ্যুতের দাম আরও বাড়বে।

বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা পরিস্থিতি চলছে। দুই বছর করোনার ধাক্কা ও ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এসেছে। ফলে আইএমএফ থেকে এই সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আর ঋণ পেতে হলে অবশ্যই ভর্তুকি কমাতে হবে। কিন্তু মনে রাখা উচিত ছিল- দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী। কষ্টে আছে সাধারণ মানুষ। ফলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধি সবার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে সীমিত আয় ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক অনটন আরও বাড়বে।

সবুজ ইউনুস: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×