অন্যদৃষ্টি
গণহত্যার দায়

সুধীর সাহা
প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:৪৬
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সৈন্যের আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সামনে অস্ত্র নামিয়ে রেখেছিল। আত্মসমর্পণ করে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছিল বৃহৎ সংখ্যার এ পাকিস্তানি সেনা। বিজয় ঘটেছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। স্বাধীনতা পেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু এ বিজয়, এ স্বাধীনতার জন্য অনেক অনেক রক্ত দিতে হয়েছিল। যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল ৯৩ হাজার সেনার অনেকেই। অগণিত নারীকে ধর্ষণ করেছিল। ধর্ষণ শেষে কিছু নারীকে হত্যা করার নারকীয়তায়ও যুক্ত ছিল বিপুলসংখ্যক সেনা এবং এ দেশে তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। তার পরও পাকিস্তানের আত্মসমর্পণকৃত সব সেনা ট্র্যাজিক হিরোর মর্যাদা নিয়েই নিজেদের উৎসভূমি পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিল।
ঘৃণা প্রদর্শন নয়; দুঃখ প্রকাশ নয়; বরং বীরের মর্যাদা দিয়ে তাদের সাদরে গ্রহণ করেছিল পাকিস্তান। একবার ভুলেও তাদের অমানবিক আর পাশবিক অত্যাচারের ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের কী ক্ষতি হয়েছিল, তা তলিয়ে দেখা কিংবা পুরো বিষয়টি তদন্ত করার কথা তারা ভাবেনি। বরং উল্টো কাজই করেছিল সেদিন পাকিস্তান।
১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে বড়দিনে শ্রীনগরের ধর্মস্থান থেকে পুণ্যস্মারক চুরির খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ গুজব নিয়ে অপপ্রচারে নামে পাকস্তানি মিডিয়া। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক শ্রেণির খবরের কাগজও সেই অপপ্রচারে যোগ দেয়। খান সেনাদের সক্রিয়তায় প্রায় গোটা পূর্ব পাকিস্তানে সেদিন নির্বিচারে সংখ্যালঘু হত্যা ও ধর্ষণ চলে। ফলে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ক্ষুধার্ত, রক্তাক্ত সংখ্যালঘু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। বড় আকারে সংখ্যালঘুর দেশত্যাগ সেই বুঝি শুরু। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক চলে চরম ও চূড়ান্ত আঘাত। কিন্তু যেহেতু সৌদি আরব, চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের এ নির্বিচার বাঙালি খুনকে সমর্থন করেছিল; পাশ্চাত্যের গণহত্যাবিষয়ক গ্রন্থগুলোতে একাত্তরের গণহত্যার সঠিক চিত্র অনেকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল; তাই সারাবিশ্ব পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা সম্পর্কে খুব একটা জানতে পারেনি। ভারতের মিডিয়া সেদিন সোচ্চার থাকলেও বিশ্বের মিডিয়া জগতে দেশটি তখন খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বাংলাদেশ কখনও এ নিয়ে বিশ্বদরবারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এত বড় গণহত্যা ঘটিয়েও তাই পাকিস্তান বিশ্ব মিডিয়ায় ধিক্কার লাভ করেনি ঠিক সেভাবে, যেভাবে করার কথা ছিল। শুধু চুকনগরেই পাকিস্তানি কনভয় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে এক দিনে প্রায় ১০ হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করলেও জেনোসাইডের ইতিহাসে তা আলোচিত নয়। পাকিস্তানের সেনারা বিশেষভাবে সেদিন বেছে বেছে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী সমর্থকদের হত্যা করলেও হিসাবের খাতায় যা ছিল তা থেকে বলা যায়, ইসলামের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত মুসলমান কর্তৃক এত মুসলমান নিধনের ঘটনা আর একটিও ঘটেনি; যেমনটা হয়েছিল ১৯৭১-এ সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে।
খুব বলিষ্ঠ কণ্ঠে না হলেও আজও বাংলাদেশে কেউ কেউ গণহত্যার বিচার দাবি করছেন। অপরাধীদের বিচার কোনো সময়ের বাঁধনে সীমাবদ্ধ করা যায় না। বাংলাদেশের অগণিত শহীদের প্রতি যদি শ্রদ্ধা অটুট থাকে, তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটিও সব সময়ের জন্য বেঁচে থাকতে পারে। সময়ের ব্যবধানে তা ম্লান কিংবা মুছে যেতে পারে না।
ইতোমধ্যে শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা নয়; সামগ্রিক গণহত্যার বিচারের দাবি এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আওয়ামী লীগ সরকার তার বিচারও শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ৪৯টি রায়ে মোট ১২৭ জনের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ফাঁসি দেওয়া হয়েছে ছয়জনকে। আজও বিচার হয়নি তাদের, যারা সেদিন যুদ্ধাপরাধের মূল হোতা ছিল। আজও পাকিস্তানে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। পাকিস্তান আজও বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের হত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি কিংবা দুঃখ প্রকাশ করেনি। বিশ্বমানবতা আজও এগিয়ে আসেনি পাকিস্তানকে বাধ্য করতে এমন নারকীয় গণহত্যার দায় গ্রহণে।
সুধীর সাহা: কলাম লেখক
[email protected]
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- সুধীর সাহা