সমকালীন প্রসঙ্গ
উচ্চশিক্ষা: দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহন

বিমল সরকার
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২২:৪৩
ইংরেজরা প্রত্যক্ষভাবে প্রায় দুইশ বছর আমাদের ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালিয়েছে। আমাদের দেশে ইংরেজি তথা আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় ইংরেজদের হাতেই। দীর্ঘ সময় ধরে শাসনের নামে শোষণ-অন্যায়-অবিচার-বৈষম্য আর দায়িত্বহীনতা তো ছিলই। তারই অধীনে ১৯২১ সালে পূর্ববঙ্গের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) স্থাপন সামান্য কোনো ঘটনা নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এ এক বিপ্লব; পূর্ববঙ্গবাসী বাঙালির পরম পাওয়া। ১৯২১ সালের পর ইংরেজ আমলে ২৬ বছরের মধ্যে দেশে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়নি। বাঙালি জাতির পরম সৌভাগ্য, স্বপ্ন আর গর্বের ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণ ও চর্চা-গবেষণার শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর এবং ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা পায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর একে একে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান আমলে- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭২ সালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ২০ বছরে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের দেশে মোটামুটি এই হলো উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণ ও চর্চা-গবেষণা করার জন্য সুস্থ ধারার বন্দোবস্ত। পরবর্তী সময়ে অনেক কিছুই হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। দেশে গত দুই বছরে ঘোষিত চারটিসহ বর্তমানে মোট ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।
লক্ষ্য করার বিষয়, এই ৫৪টি পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইংরেজ আমলের ১৯০ বছরে মাত্র একটি এবং পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরে ৫টি অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ২১৩ বছরে দেশে মোট ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৫০ বছরের প্রথম ২০ বছরে একে একে স্থাপিত হয় আরও ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। আর বাকি ৩১ বছরে প্রতিষ্ঠা করা হয় ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়।
অর্থাৎ আগে যেমনই থাক; স্বীকার না করে উপায় নেই- উচ্চশিক্ষায় আমাদের দেশে সাম্প্রতকি দশকগুলোতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে গেছে। সরকারি-বেসরকারি মিলে দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন আমাদের। একইভাবে ১১০টি মেডিকেল কলেজ; রয়েছে পাঁচ বিভাগীয় শহরে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ৭০০-এর বেশি সরকারি কলেজ। ডিগ্রি স্তরে পাঠদান উপযোগী কলেজ ২ সহস্রাধিক। আর সরকারি-বেসরকারি মিলে ৮৮১টি কলেজে অনার্স এবং ১৭০টি কলেজে মাস্টার্স কোর্স পড়ানোর ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত। যদি বলা হয়, শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটে গেছে- অন্তত ঔপনিবেশিক আমলের তুলনায়; তাহলেও ভুল হবে না।
তবে উপযুক্ত দেখভালের অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক কিছু থাকার পরও কী যেন নেই আমাদের! ইদানীং শিক্ষাক্ষেত্রে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি অধিকাংশ মানুষকে সব সময় ভাবনা ও দুর্ভাবনায় আচ্ছন্ন করে রাখে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় আর বিভাগে বিভাগে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন- পরিকল্পনা বাস্তবায়নের খুব একটা বাকি নেই। ঘর থেকে বেরোলেই যেন কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষা দিনে দিনে অনেকটা গণশিক্ষায় রূপ নিয়েছে। অথচ এ নিয়ে আমরা খুব একটা গর্ব করতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সবই বিদ্যমান- উপাচার্য, শিক্ষক; শিক্ষার্থীরও অভা নেই। কিন্তু আসল বিষয়টাই যেন নেই। এখানে উচ্চশিক্ষার মান আজ দারুণভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন। এ নিয়ে সচেতন মহলে আলোচনা-সমালোচনার কোনো শেষ নেই।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক যাযাবরের (বিনয়কুমার মুখোপাধ্যায়) অমর সৃষ্টি 'দৃষ্টিপাত' উপন্যাসটির কথা সবার, বিশেষ করে বয়স্ক সচেতন পাঠকদের মনে বোধ করি এখনও গেঁথে রয়েছে। খুবই সুখপাঠ্য; একনাগাড়ে বা বারবার পড়ার মতো একটি বই। একসময় বিশেষ করে তরুণ-তরুণীর মুখে শোনা যেত- 'যাযাবরের দৃষ্টিপাত' অথবা 'দৃষ্টিপাতের যাযাবর'। উদ্ৃব্দতি হিসেবে পাতার পর পাতা না হলেও স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় বইটির বাক্যের পর বাক্য তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া অনেকেই পরিস্থিতি-পরিবেশে অনর্গল আওড়িয়ে থাকেন। যাযাবর তাঁর কালজয়ী ওই উপন্যাসটি শেষ করেন এই বাক্যটি দিয়ে- 'যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।' আমাদের উচ্চশিক্ষপ্রতিষ্ঠানেও যেন এমন শিক্ষারূপী আগুন আছে, যা আলো দেয় না অথচ দহন করে।
বিমল সরকার: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক