সমকালীন প্রসঙ্গ
'গুম' হওয়া রবীন্দ্রনাথের ফিরে আসা

আমীন আল রশীদ
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২৩:১৭
পেরেকবিদ্ধ 'গীতাঞ্জলি' হাতে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর মুখ স্কচটেপ দিয়ে বন্ধ; কথা বলতে পারছেন না। মঙ্গলবার এ রকম একটি অস্থায়ী ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সেটি হাওয়া। এই ঘটনার পরে সেখানে একটি ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছিল- 'গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ!' শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আবর্জনার স্তূপ থেকে ভাস্কর্যের খণ্ডিত মস্তক উদ্ধার করা হয়। শনিবার দেখা গেল, একই স্থানে পুরোনো মস্তক যুক্ত করে নতুন ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। (সমকাল অনলাইন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
সংবাদমাধ্যম বলছে, বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের কয়েকজন শিক্ষার্থীর উদ্যোগে রাজু ভাস্কর্যের পাশে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল। এর কাছেই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা; যে মেলায় এবার বেশ কয়েকটি বই এবং একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। নতুন করে আলোচনায় এসেছে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং লেখকের লেখার স্বাধীনতার প্রসঙ্গটিও। এসব বাস্তবতা মাথায় রেখেই সম্ভবত ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছিল।
অবশ্য বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার তর্ক নতুন নয়। বাকস্বাধীনতার সীমারেখা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়টিও। বিশেষ করে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'শনিবার বিকেল' সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে আটকে থাকার বিষয় নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর আসে- প্রায় চার বছর সেন্সর বোর্ডের ঝুলিতে 'নিষিদ্ধ' হয়ে পড়ে থাকার পর অবশেষে মুক্তির সম্ভাবনা মিলেছে 'শনিবার বিকেল'-এর। কিন্তু এই সংবাদের পর আর কোনো অগ্রগতি নেই। সিনেমাটি এখনও ছাড়পত্র পায়নি। এ নিয়ে ফারুকী নিজেও বিভিন্ন সময় তাঁর ফেসবুক ওয়ালে ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশার কথা লিখেছেন। দেশের বরেণ্য লেখক ও শিল্পীর অনেকেই শনিবার বিকেল মুক্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে লিখেছেন। কিন্তু 'শনিবার বিকেল' শনির দশা কাটাতে পারেনি।
বলা হচ্ছে, সিনেমাটির পটভূমি ২০১৬ সালে সংঘটিত হোলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলা। কিন্তু সিনেমায় সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। যদিও ফারুকী বরাবরই দাবি করেছেন, এখানে হোলি আর্টিসানের ঘটনা তুলে ধরা হয়নি। গত বছর ২ সেপ্টেম্বর নিজের ফেসবুক ওয়ালে তিনি লিখেছিলেন- 'আমার ছবিতে কোথাও হোলি আর্টিসান মেনশন করা নেই, আমার ছবিতে হোলি আর্টিসানের কোনো রিয়েল ক্যারেক্টার পোর্ট্রেট করা হয়নি, তারপরও স্রেফ এই দেশের হতভাগা ফিল্মমেকার হওয়ার অপরাধে আমার ছবিটাকে সাড়ে তিন বছর আটকে রাখা হইলো।' প্রশ্ন হলো, যে সিনেমায় হোলি আর্টিসানের কোনো চরিত্র নেই বলে পরিচালক দাবি করছেন, সেখানে এটি আটকে রাখা হচ্ছে কেন? তা ছাড়া কোনো একটি ঘটনা নিয়ে সিনেমা বা ফিকশন তৈরি করতে গেলে সেখানে যে ঘটনার হুবহু তুলে আনতে হবে- এমন নিয়ম কোথায় লেখা আছে? এটি মানতে গেলে কি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে নিয়ে গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখা বা নাটক-সিনেমা বানানো সম্ভব?
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর 'আই থিয়েটার' নামের একটি অ্যাপে আংশিকভাবে মুক্তি পায় 'নবাব এলএলবি'। এই সিনেমায় ধর্ষণের শিকার এক নারীকে জেরা করার দৃশ্যে পুলিশকে হেয় করা হয়েছে- এমন অভিযোগে দায়ের করা পর্নোগ্রাফির মামলায় পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
শুধু পরিচালক ও অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করা কিংবা সেন্সর বোর্ডে সিনেমা আটকে রাখাই নয়, বইয়ের কোনো কনটেন্ট যদি সরকার বা বিশেষ কোনো দলকে প্রশ্নের মুখে ফেলে, তাহলে সেই বইটি বইমেলায় নিষিদ্ধ করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। অথচ ওই একই ধরনের কনটেন্ট নিয়ে অসংখ্য বই এর আগেও লেখা হয়েছে।
বাস্তবতা হলো, শুধু কনটেন্ট বা সমালোচনার কারণে যদি বইয়ের বিক্রি ও প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হয়, তাহলে সেই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা, কোনো একটি বই নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে মূলত রাষ্ট্রীয়ভাবে ওই বইটির বহুল বিজ্ঞাপন করে দেওয়া হয় এবং মানুষ কোনো না কোনোভাবে বইটি সংগ্রহ করে পড়ে ফেলে। অর্থাৎ যাঁরা ওই বই কিংবা লেখক সম্পর্কে জানতেন না, তাঁদের কাছেও বইটি পৌঁছে যায়।
এসব তর্কের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ 'গুম' হয়ে গেছেন এবং ফিরেও এসেছেন। কিন্তু তাতে করে বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরেছে কিনা স্পষ্ট নয়। আমরা জানি, গুম নিয়ে সরকারকে দেশের বাইরে বিব্রতকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। সরকার বারবারই সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে। এমন পরিস্থিতিতে আর কিছু না হোক, রবীন্দ্রনাথের অস্থায়ী ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে শব্দটি নতুন মাত্রা পেল।
ভাস্কর্যকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং লেখক ও শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি নতুন করে সামনে আসায় বিষয়টি স্বাগত। কিন্তু যা খুশি তা-ই বলা কিংবা লেখা; অন্যের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন; ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে কোনো একটি গোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং কোনো সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করাও যে সংবিধান ও আইন অনুমোদন করে না, সেটিও মাথায় রাখা দরকার। সংবিধানে চরম স্বাধীনতা বলে কোনো শব্দ নেই। বরং প্রতিটি স্বাধীনতাই শর্তসাপেক্ষ। এই শর্ত না থাকলে পৃথিবীতে যে নৈরাজ্য হবে, সেটি ঠেকানো কঠিন। আবার সেই শর্তগুলো রাষ্ট্র যদি নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করে; রাষ্ট্র যদি নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে সংবিধান ও আইনের দোহাই দেয়, সেটির বিরুদ্ধে নাগরিকরা নির্ভয়ে কথা বলতে পারছে কিনা- সেটিও বাকস্বাধীনতার একটি বড় মানদণ্ড।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক