ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

আন্তর্জাতিক

আমেরিকার আধিপত্যে চীনের বাগড়া

আমেরিকার আধিপত্যে চীনের বাগড়া

তিমুর ফোমেনকো

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২২:২২

গত ২০ ফেব্রুয়ারি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় 'যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য এবং এর বিপদ' শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির বিশ্ব শাসনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড আক্রমণ বললে অত্যুক্তি হবে না। নিবন্ধটি চীনের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল। এত কঠোর ভাষায় ওয়াশিংটনের সমালোচনা চীনকে এর আগে করতে দেখা যায়নি। কাকতালীয় বিষয় হলো, এটি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক ভাষণের সঙ্গে মিলে যায়; যেখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করে গোটা বিশ্বের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য অর্জন এবং বজায় রাখার জন্য ওয়াশিংটনের বহুমুখী চেষ্টার কিছু বিষয় তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে ইরাক এবং আফগানিস্তানে সামরিক হামলা, একই সঙ্গে অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের নামে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ।

ওই নিবন্ধে আরব বসন্ত, চিলিতে সিআইএর মাধ্যমে অভ্যুত্থানসহ লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং কিউবা ও ভেনিজুয়েলার সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা যেমন আলোচিত; তেমনি ইউক্রেন, জর্জিয়া ও কিরগিজস্তানের মতো সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে 'রঙিন বিপ্লব'-এর সংখ্যা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গণতন্ত্রকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অনেক দেশকে নিজের পক্ষে নিতে বাধ্য করে; নিবন্ধে তার নিন্দা করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার বিরোধীদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং নানাবিধ বল প্রয়োগ করে তাদের পঙ্গু করে দেয় এবং 'বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার প্রধান বিষয়' হিসেবে যেভাবে মার্কিন ডলার সামনে নিয়ে আসে, তারও নিন্দা করা হয়েছে নিবন্ধটিতে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগে কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এমন আক্রমণাত্মকভাবে চড়াও হয়নি। বহু বছর ধরে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের শত্রুতার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে চীন সর্বোচ্চ সংযত আচরণ করে আসছে। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই এটি বিশ্বাস করছিল- আমেরিকার সঙ্গে চীনের স্বার্থগত বিষয় রয়েছে এবং মার্কিন-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নত ও স্থিতিশীল হতে পারে। এই বিশ্বাসের বিশেষ কারণ হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে চীনের সঙ্গে যে তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়; ট্রাম্পের বিদায়ের পর জো বাইডেনের অধীনে সম্পর্ক 'স্বাভাবিক' হিসেবে ফিরে আসতে পারে। সেটা আসলে ভুল। দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর দেখা যাচ্ছে, বাইডেন আরেক কাঠি সরেস। জো বাইডেন নিজেকে ট্রাম্প এবং তাঁর সহকর্মীদের চেয়ে চীনের প্রতি আরও বেশি যুদ্ধংদেহী হিসেবে হাজির করেছেন। তাঁর আচরণে দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে পৌঁছে গেছে। 'আমেরিকা ফার্স্ট' স্লোগানে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্রাম্পিয়ান বা ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে নীতি ছিল, সেখানে রূপান্তর ঘটিয়ে তিনি সামরিক এবং কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের একটি সর্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছেন, যা নাটকীয়ভাবে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ট্রাম্প আলোচনার পক্ষে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শুল্ক্ক সুবিধা ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে। অন্যদিকে জো বাইডেনের শব্দভান্ডারে যেন 'সমঝোতা' বলতে কোনো শব্দই নেই।

বাইডেন প্রশাসন বারবার দাবি করেছে, তারা বেইজিং থেকে 'গার্ডরেইলস' বা রক্ষাকবচ ও 'যোগাযোগের লাইন' চায়। কিন্তু বাস্তব কার্যকলাপ থেকে যা দেখা যাচ্ছে তা এর উল্টো। বলা যায়, আচরণেই ওয়াশিংটনের আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাইওয়ানে সদ্য সাবেক মার্কিন প্রতিনিধি সভার স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির অত্যন্ত উত্তেজনাকর সফরে বাইডেন প্রশাসনের সম্মতিদান, বেলুন নিষয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং অনেক দেশকে চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে উপকরণ সরবরাহ করতে নিষেধ করা ইত্যাদি। বেইজিং অবশেষে এ উপসংহারে পৌঁছেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংলাপ করার দরকার নেই। এসব সংলাপ কিংবা আলাপ-আলোচনা শুধু সময় নষ্টের আয়োজন। চীন এমন এক যুদ্ধবাজ, আধিপত্যবাদী ও কপট অভিনেতার মুখোমুখি হয়েছে, যে আপাতদৃষ্টিতে তার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে চায় আবার কৌশলগতভাবে একে যে কোনো মূল্যে ভাঙতেও চায়।

চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করছে যুক্তরাষ্ট্র। বহু দশক ধরে চীনের দর্শন ছিল ওয়াশিংটনের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো; আমেরিকানদের শীতল যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের নীতির দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখা এবং কমিউনিস্ট পার্টির অথনৈতিক সমৃদ্ধির যে অগ্রাধিকার তা অব্যাহত রাখা। ঠিক এই কারণেই আগে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৈরী আচরণ করেছিল, তখনও চীন দীর্ঘদিন ধরে দ্বিধাহীন ও সংযত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উদ্ধার করার প্রচেষ্টায় ছিল চীন এবং সম্পর্কে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছিল।

চীন এখন স্বীকার করেছে- তার অগ্রাধিকার ওয়াশিংটনকে খুশি করা নয়। চীন নিজের অব্যাহত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে একটি বহুমুখী বিশ্বকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে, যেখানে আমেরিকার শক্তি ক্রমহ্রাসমান। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকান আধিপত্যকে বিশ্বের অস্থিতিশীলতা, বিশৃঙ্খলা, অসমতা এবং সংঘাতের সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যেটা বলা চলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিনের মন্তব্যেরই প্রতিফলন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেমন অন্য কোনো দেশের সঙ্গে দেশটির উত্থানের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়ার আগ্রহ নেই, তেমনি বিশ্বশক্তিরূপে কোনো রাষ্ট্র দাঁড়াতে চাইলে তারা তার বিরুদ্ধাচরণ করে, যাতে মার্কিন একচেটিয়া বিশ্ব-শাসন টিকিয়ে রাখার পথে কোনো চ্যালেঞ্জ না আসে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, বিশ্বে আধিপত্য চালানোর অধিকার তাকে ঈশ্বর দিয়েছে এবং এতে অন্য কারও ভাগ বসানোর সুযোগ নেই। ফলে বিশ্বের 'স্থিতিশীলতা'র জন্য সে সামান্য অবদান রাখতেও রাজি নয়। সে জন্যই যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে চীনের একীভূত হওয়ার সব পথে দেয়াল তোলার জন্য যা যা করা যায়, সবকিছুই করে চলছে। যদিও মার্কিন এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে এই নয়; বেইজিং বেপরোয়া বা ঝুঁকিপূর্ণ কিছু করবে। বরং এর অর্থ এই, তারা অবশেষে জেগে উঠেছে এবং তারা যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে তা তারা বুঝতে পারছে। সে জন্যই আমেরিকান শাসনের সঙ্গে চীনের কয়েক দশকের যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সেটি আর থাকছে না। 

তিমুর ফোমেনকো: রাজনৈতিক বিশ্নেষক, আরটি ডটকম থেকে ভাষান্তর, মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×