আন্তর্জাতিক
আমরা যে মুক্তবাজার চাই

জোসেফ স্টিগলিজ
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ২২:৩৪
দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন পতাকায় মুড়িয়ে রেখে রিপাবলিকান পার্টি দাবি করে আসছে- তারাই 'স্বাধীনতার' রক্ষক। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রাচীন এ দলটি বিশ্বাস করে, নাগরিকদের আগ্নেয়াস্ত্র বহনের পাশাপাশি ঘৃণাত্মক বক্তব্যদান; ভ্যাকসিন ও মুখোশ পরিহার করার স্বাধীনতা থাকা উচিত। করপোরেশনগুলি সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। তারা মনে করে, তাদের ক্রিয়াকলাপ যদি জলবায়ুর অসংশোধনীয় পরিবর্তন ঘটায়; এমনকি পৃথিবী নামক এ গ্রহকে ধ্বংসও করে, তবুও বিশ্বাস করতে হবে- 'মুক্তবাজার'ই শুধু সমস্যার সমাধান দিতে পারে; ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের 'নিয়ন্ত্রণমুক্ত' রাখা উচিত; এমনকি তাদের কর্মকাণ্ড সমগ্র অর্থনীতিকে ধ্বংস করার শঙ্কা থাকলেও।
তবে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট, অতিমারি ও জলবায়ু সংকট ত্বরান্বিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এটা সবার বোঝা উচিত, স্বাধীনতার এহেন ধারণা আধুনিক বিশ্বের জন্য অত্যন্ত নির্মম শুধু নয়; অতিসরলীকৃতও বটে। বিংশ শতাব্দীর মহান দার্শনিক ইসাইয়া বার্লিন বলেছিলেন, 'নেকড়েদের অবাধ অধিকার মানে ভেড়ার মৃত্যু। অন্যভাবে বললে- কারও জন্য যা স্বাধীনতা, তা অন্যের জন্য স্বাধীনতাহীনতাও হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুলি না খেয়ে স্কুল বা দোকানে যাওয়ার স্বাধীনতার বিনিময়ে বন্দুক বহনের স্বাধীনতা এসেছে। এই বিশেষ স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে আজ অবধি হাজার হাজার নিরীহ মানুষ; যাদের মধ্যে অনেক শিশুও আছে; মারা গেছে। লাখ লাখ লোক হারিয়েছে ভয় না পাওয়ার স্বাধীনতা, যা ফ্র্যাঙ্কলিন ডেলানো রুজভেল্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন।
একটি সমাজের মধ্যে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতা অবশ্যই একে অপরের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে এ নিয়ে যত আলোচনা হোক, তা যদি যুক্তিযুক্ত হয় তাহলে এর অনিবার্য অনুসিদ্ধান্ত হতে হবে- একটি আরমালাইট (এআর)-১৫ রাইফেল সঙ্গে রাখার অধিকার অন্যদের বেঁচে থাকার অধিকারের চেয়ে বেশি 'পবিত্র' নয়।
জটিল এ আধুনিক সমাজে এমন অসংখ্য উপায় রয়েছে, যেগুলো ব্যবহার করে নিজের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে অপরের ক্ষতি করেও একজন বেঁচে যেতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো অব্যাহতভাবে আমাদের 'তথ্য ইকোসিস্টেম'কে বিকৃত তথ্য ও বিষয়বস্তু দিয়ে দূষিত করে চলেছে, যে ক্ষতি সম্পর্কে সবাই জানে। যদিও প্ল্যাটফর্মগুলো তথ্যের এহেন প্রবাহ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নিজেদের নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করে, তাদের অ্যালগরিদমগুলো কিন্তু সামাজিকভাবে ক্ষতিকারক পদার্থের প্রচার করে চলেছে। কিন্তু এ জন্য সামান্যতম মূল্য না দিয়ে প্ল্যাটফর্মগুলো প্রতি বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করছে।
প্রযুক্তিজগতে আধিপত্যকারী মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে পিঠ বাঁচাতে সহায়তা জোগাচ্ছে ১৯৯০-এর দশকের একটি আইন, যা মূলত ডিজিটাল অর্থনীতিতে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল। এ আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি মামলা এখন মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও প্রশ্ন উঠেছে- অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোকে তাদের কর্মের জন্য জবাবদিহি এড়ানোর সুযোগ দেওয়া উচিত কিনা।
অর্থনীতিবিদদের জন্য স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, তিনি কী এবং কতটুকু করতে পারবেন। একজনের 'সুযোগের পরিসর' যত বড় হবে, তিনি তত বেশি স্বাধীন হবেন। অনাহারক্লিষ্ট কেউ যখন ক্ষুন্নিবৃত্তিতে ব্যস্ত থাকে, তখন সে আসলে কোনো স্বাধীনতাই ভোগ করছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা হলো, কারও নিজের সম্ভাবনা উপলব্ধি করার ক্ষমতা। যে সমাজে জনসংখ্যার বড় অংশের এ ধরনের সুযোগের অভাব রয়েছে, যেমনটি উচ্চ দারিদ্র্য ও বৈষম্যময় সমাজে দেখা যায়, সে সমাজ প্রকৃতপক্ষে মুক্ত নয়।
জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগ (যেমন শিক্ষা, অবকাঠামো ও মৌলিক গবেষণা) সব ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত সুযোগ প্রসারিত ও কার্যকরভাবে সবার স্বাধীনতা বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু এ ধরনের বিনিয়োগের জন্য প্রচুর কর সংগ্রহের প্রয়োজন হয়, যদিও অনেক ব্যক্তি বিশেষ করে এমন একটি সমাজে যেটি লোভকে প্রাধান্য দেয়, বরং তাদের ন্যায্য দায় পরিশোধ না করেই বিনামূল্যে ঘুরে বেড়াতে চায়।
এটি একটি ক্লাসিক সামাজিক সমস্যা। শুধু জবরদস্তির মাধ্যমে প্রত্যেককে তাদের কর দিতে বাধ্য করে। আমরা জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারি।
সৌভাগ্যবশত, সমাজের বিনিয়োগে অবদান রাখতে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য করা হয়েছে এমন সব ব্যক্তিও এর ফলে ভালো থাকতে পারে। তারা এমন একটি সমাজে বাস করবে যেখানে তাদের সন্তান এবং অন্য সবার জন্য প্রসারমান সুযোগ তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে জবরদস্তিই মুক্তির উৎস।
নিওলিবারেল অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘকাল ধরে এসব বিষয়কে উপেক্ষা করেছেন। তাঁরা বরং গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিকে সেসব প্রবিধান ও কর থেকে 'মুক্ত' রাখার ওপর, যেগুলো করপোরেশনগুলোর (যারা বরাবরই নানাবিধ সরকারি ব্যয় থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত) ওপর আরোপিত হতে পারে। কিন্তু শিক্ষিত শ্রমশক্তি তৈরি করা না হলে চুক্তি কার্যকরের স্বার্থে আইনের শাসন নিশ্চিত না হলে অথবা পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা ও বন্দর ছাড়া আমেরিকান ব্যবসা আজ কোথায় থাকত?
নাওমি ওরেসকেস এবং এরিক এম কনওয়ে তাঁদের নতুন বই দ্য বিগ মিথ-এ দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যবসায়িক কায়েমি স্বার্থ আমেরিকান জনসাধারণের মাঝে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দশকগুলোতে কট্টর সরকারি খাতবিরোধী, পুঁজিবাদের 'মুক্তবাজার' দৃষ্টিভঙ্গি ঢুুকিয়ে দিয়েছিল। ওতে 'স্বাধীনতা'বিষয়ক বাগাড়ম্বরই ছিল মুখ্য। শিল্পের কর্ণধার এবং তাদের দাসানুদাস একাডেমিশিয়ানরা পদ্ধতিগতভাবে আমাদের জটিল অর্থনীতিকে; যা ছিল বেসরকারি, সরকারি, সমবায়, স্বেচ্ছাসেবী এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের একটা মিশেল- নিছক একটা 'মুক্ত ব্যবসায়িক' অর্থনীতি হিসেবে পুনর্বিন্যস্ত করেছেন।
মিল্টন ফ্রিডম্যানের 'ক্যাপিটালিজম অ্যান্ড ফ্রিডম' এবং ফ্রেডরিখ হায়েকের 'দ্য রোড টু সার্ফডম'-এর মতো বইয়ের কথা ভাবুন; ওই বইগুলোতে পুঁজিবাদকে কোনো রাখঢাক ছাড়া স্বাধীনতার সমতুল্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। পুঁজিবাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির মূলকথা হলো শোষণের স্বাধীনতা, যেখানে একচেটিয়া পুঁজিপতিরা সম্ভাবনাময় নবীন ব্যবসায়ীদের পদদলিত করা এবং তাদের কর্মীদের ছিবড়ে বানানোর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা ভোগ করবে; আর দোকানদারদের থাকবে তাদের গ্রাহকদের শোষণের অবাধ অধিকার। এটাকে আমরা যে নামই দিই না কেন; আমাদের কাঙ্ক্ষিত অর্থনীতি হতে পারে না। এটি এমন অর্থনীতিও নয়, যেখানে সমৃদ্ধির যতটা সম্ভব সুষম বণ্টন উৎসাহিত হয়। আবার এটি যে ধরনের লোভী ও ভোগবাদী ব্যক্তিদের পুরস্কৃৃত করে, সে রকমও আমরা হতে চাই না।
হ্যাঁ, আমরা মুক্তবাজার চাই এবং প্রবলভাবেই তা চাই। কিন্তু এমন বাজার হলো সেগুলো, যা সর্বোপরি একচেটিয়া ফাঁস ও দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত এবং যেখানে মতাদর্শগত নানা কল্পকথা ছড়িয়ে বড় ব্যবসাগুলোর পক্ষে অযৌক্তিক ক্ষমতা ধারণ অসম্ভব।
জোসেফ স্টিগলিজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ; কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন