ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

প্রতিবেশ

নিরাপদ অঞ্চলেও শকুনের মৃত্যু

নিরাপদ অঞ্চলেও শকুনের মৃত্যু

পাভেল পার্থ

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০

বিশ্ব বন দিবসের পরদিন মৌলভীবাজারের একাটুনা ইউনিয়নের বড়কাপন গ্রামের বুড়িকোনা বিলে কিছু শকুনের লাশ পড়ে থাকার খবর পায় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং আইইউসিএন। পরদিন ওই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে ১১টি শকুনের লাশ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে আসেন; কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় সিলেটে পাঠানো হয়। বন্যপ্রাণী বিভাগ ঘটনাস্থল থেকে আরও তিন শকুন, শিয়াল, বিড়াল ও কুকুরের লাশ এবং কয়েকটি বিষের বোতল উদ্ধার করে।

সিলেট প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা গলিত শকুনের লাশ পরীক্ষা করে জানান, পাখিগুলো ৭ মার্চের দিকে মারা গেছে। এ ঘটনায় ২৩ মার্চ মৌলভীবাজার সদর বন্যপ্রাণী রেঞ্জের বর্ষিজোড়া বিট কর্মকর্তা ‘অবৈধভাবে ১৩টি বাংলা শকুন ও শিয়াল হত্যা’ বিষয়ে মৌলভীবাজার মডেল থানায় একটি এজাহার করেন। জিডি নম্বর ১৪৫৩।

২৪ মার্চ ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে সংবাদমাধ্যম জানায়, বড়কাপন গ্রামের কচনু মিয়া ও রোকন মিয়ার পোষা ছাগল শিয়ালে কামড় দেয় এবং তারা মরা ছাগলের শরীরে বিষ মিশিয়ে রেখে দেন, যা খেয়ে শিয়াল, কুকুর ও শকুন মারা যেতে পারে। কোনো রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় শকুন মরেছে কিনা, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ মৌলভীবাজার থেকে লাশগুলো সিলেটে পাঠিয়ে জানা যায়, সেখানেও এই পরীক্ষা সম্ভব হয় না।

সাম্প্রতিক এই শকুন হত্যার নিদারুণ কাহিনি প্রবলভাবে শকুনের প্রতি আমাদের অবহেলা এবং উদাসীনতাকে প্রমাণ করেছে। প্রমাণ করেছে, শকুনের জন্য ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলেও শকুনেরা নিরাপদ নয়। মাত্র ২৬০টি শকুন দেখাশোনার জন্য বহু প্রকল্প, কর্মসূচি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত আছেন। কিন্তু একের পর এক শকুন মৃত্যুর বহুদিন পরে ঘটনাটি আমরা জানতে পেরেছি। সংবাদমাধ্যম জানায়, একটি শকুনের শরীরে স্যাটেলাইট ডিভাইস ছিল, বেশ কিছুদিন সেটির অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় তারা মাঠ পর্যায়ে লোক পাঠিয়ে ঘটনাটি জানতে পারে। শকুন তো আর মুনিয়া বা টুনটুনি নয়; দূর থেকে দেখা যাওয়া বৃহৎ পাখি। একের পর এক শকুন মরল আর জানাজানি হলো না! জায়গাটি দেশের বাইরেও নয়। কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, সংবাদমাধ্যম, স্থানীয় সরকার, প্রশাসন কারও নজরেই এলো না! এমনকি শকুনের জন্য ঘোষিত নিরাপদ অঞ্চলে একটি রাসায়নিক পরীক্ষাগারও নেই।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ১০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের দুটি অঞ্চলকে দেশের দুটি শকুন নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করে। ২০১৩ সালে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় শকুন পুনরুদ্ধার কমিটি গঠিত হয়। শকুন নিরাপদ অঞ্চল-১ এর আওতায় রয়েছে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ি। শকুন নিরাপদ অঞ্চল-২ এর আওতায় আছে ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, মাদারীপুর, যশোর, গোপালগঞ্জ (টুঙ্গিপাড়া ছাড়া), নড়াইল, শরীয়তপুর, বরিশাল, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর (ভান্ডারিয়া ছাড়া), ঝালকাঠি, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এই নিরাপদ অঞ্চলের ভেতর ৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের অঞ্চলকে ‘কোর জোন’ চিহ্নিত করা হয়েছে। শকুন নিরাপদ অঞ্চল-১ এর কেন্দ্রবিন্দু মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বনাঞ্চল এবং অঞ্চল-২ এর কেন্দ্রবিন্দু সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ। শকুনের জন্য নিরাপদ অঞ্চল-১ এর কেন্দ্রবিন্দুতেই এবার খুন হলো ১৩ শকুন।

শকুনের ব্যাপক মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে ডাইক্লোফেনাকের পাশাপাশি কিটোপ্রোফেন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ ছাড়াও ক্ষতিকর ফ্লুনিক্সিন ও এসিক্লোফেনাকও যেন দেশের বাজারে বিক্রি না হয়, সে বিষয়েও সরকার অঙ্গীকার করেছে। শকুনের জন্য নিরাপদ মেলোক্সিক্যাম ওষুধ প্রাণিসম্পদের চিকিৎসায় ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশব্যাপী না হোক শকুনের জন্য ঘোষিত অঞ্চলে এসব বিপজ্জনক ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, তার কোনো নিয়মিত তদারকি কি আছে মাঠ পর্যায়ে? কারণ, নিষিদ্ধ হওয়ার বহু বছর পরেও দেশের অনেক বাজারে ডাইক্লোফেনাক বিক্রি হতে দেখেছি। এমনকি হতে পারে এখনও কোনো না কোনোভাবে প্রাণিসম্পদের জন্য ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন ব্যবহৃত হচ্ছে। ডাইক্লোফেনাক ব্যবহার করা মৃত গরু বা ছাগল খেয়ে মরেছে শকুনের দল।

ঘটনাস্থল থেকে প্রশাসন যে বিষের বোতল জব্দ করেছে তার নাম ‘সেমকাপ ৫০ ইসি’। লেবেলে লেখা আছে, সিঙ্গাপুরের প্যানচেম ইন্ডাস্ট্রিজ পিটিই লিমিটেড এটি প্রস্তুত করে এবং বাংলাদেশের নাফকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ‘সেমকো করপোরেশন লিমিটেড’ এটি দেশে বাজারজাত করে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রেজিস্টার্ড বালাইনাশকের একটি তালিকা অনলাইনে উন্মুক্ত রেখেছে। দেখা যায় এসিআই, অটোক্রপকেয়ার লিমিটেড, আথেরটন ইমব্রোস ক্যারি লিমিটেড, এগ্রোকেয়ার লিমিটেড, আলফা এগ্রো লিমিটেড, পেট্রোচেম (বিডি) লিমিটেড, পদ্মা এগ্রো স্প্রেয়ার্স কোম্পানি, বিসমিল্লাহ করপোরেশন লিমিটেড, সেতু পেস্টিসাইড লিমিটেড, নাফকো, কৃষি ক্রপকেয়ার লিমিটেড– এ রকম ১৩টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ফেনথোয়েট পণ্য সেই তালিকায় নিবন্ধনকৃত।

‘সেমকাপ ৫০ ইসি’ নামে সেতু পেস্টিসাইড লিমিটেডের পণ্যটি নিবন্ধনকৃত। তালিকায় ‘সেমকো করপোরেশন লিমিটেড’-এর কোনো পণ্যের নিবন্ধন নেই, কিন্তু নাফকো (প্রাইভেট) লিমিটেডের ‘রুবি ৫০০ ইসি (নিবন্ধন নং-এপি-৮২৭)’ নিবন্ধনকৃত। শকুনের লাশের পাশ থেকে সংগ্রহ করা সেমকোর ‘সেমকাপ ৫০ ইসি’ এই তালিকায় নেই। তাহলে কি এটি নিবন্ধন হয়নি? শকুনের লাশের পাশে পাওয়া বিষের বোতলগুলো কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উল্লিখিত অনলাইন তালিকায় নেই। আদতেই এর অনুমোদন আছে, না নেই; জানা জরুরি।

বিশ্বে ২৩ প্রজাতির শকুনের ভেতর বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুন দেখা যেত। এর ভেতর ৩ প্রজাতির শকুন স্থায়ীভাবে বাস করত। রাজশকুন দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলা শকুন আর সরুঠোঁট শকুন আবাসিক শকুন হিসেবে টিকে আছে। গ্রিফন শকুন, হিমালীয় শকুন, কালা ও ধলা শকুনেরা পরিযায়ী হিসেবে মাঝেমধ্যে আসে।

২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘বার্ডস অব প্রে প্রোগ্রাম’ এবং লন্ডনের ‘হউক কনজারভেন্সি ট্রাস্ট’ আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস পালনের উদ্যোগ নেয়। প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালে শকুন নিয়ে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। ডাইক্লোফেনাক বিক্রি ও ব্যবহার হতে দেখলে মানুষকে বুঝিয়েছি। তবুও শকুন সবাই বাঁচতে পারল না। আশা করি, মৌলভীবাজারে সাম্প্রতিক শকুন, কুকুর, শিয়াল হত্যা বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। অন্ততপক্ষে দেশের দুটি নিরাপদ শকুন অঞ্চলে শকুনের বিচরণ ও সংসার সুরক্ষিত রাখতে রাষ্ট্র রাজনৈতিক অঙ্গীকার জোরালো করবে।

পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
[email protected]

আরও পড়ুন

×