ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

অন্যদৃষ্টি

মেট্রোর শহরে যানজট

মেট্রোর শহরে যানজট

এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ০৭ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৩ | ২০:০১

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। গত বুধবারের বিকেল। রাজধানী ঢাকার পল্লবী থেকে শ্যামলী যাব। কাছাকাছি দূরত্বের গন্তব্য। ইফতারের আগে শ্যামলী পৌঁছাতে যাতে কোনো ঝুঁকি না হয়, তাই দুই ঘণ্টা হাতে সময় নিয়ে বের হই। এতে অবশ্য ইফতার শুরুর মিনিট বিশেক আগেই শ্যামলী গিয়ে পৌঁছাই। ইফতারের আগে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেও সময় যে কেড়ে নিল দুই ঘণ্টা; মনের মধ্যে তাই একটু খচখচানি রয়ে গেল। এভাবে ঠিক কতখানি শ্রমঘণ্টার অপচয় হচ্ছে রাজধানীবাসীর প্রতিদিন– স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন জাগতে পারে।

 যানজটে ভোগান্তির শহর হিসেবে বিশ্বের পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। সময় অপচয় ও ট্রাফিকের অদক্ষতা সূচকেও এগিয়ে ঢাকা। বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স ২০২৩-এ এমন তথ্য জানা গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৩৯টি শহরকে বিবেচনায় নিয়ে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ঢাকা মহানগরের জীবনযাত্রায় সবচেয়ে প্রকট ও জটিল সমস্যা হলো যানজট। এটি নিয়ে অনেক বছর ধরে অনেক কথা বলা হচ্ছে; নানা রকম উদ্যোগের কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কিন্তু সমাধান? উল্টো দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। এখন নামবিওর সমীক্ষা আমাদের স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে– ঢাকা শহরের যানজট দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। বিশ্বের অনেক ধনী ও উন্নত দেশের বড় বড় শহরেও যানজটের সমস্যা আছে। কিন্তু ঢাকা শহরের যানজট সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। সবচেয়ে হতাশার কথা, এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হুট করে বা এক দিনে ঘটেনি। আমাদের চোখের সামনে এই সমস্যা পুঞ্জীভূত হতে হতে আজ ব্যাপকতা লাভ করেছে। নাগরিক হিসেবে এর পরিণতি ভোগ করাই যেন আমাদের নিয়তি! ভবিষ্যতে এই যানজট কোথায় গিয়ে ঠেকবে? মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, এই যানজট সমাধানের চিন্তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদৌ আছে কিনা!

ঢাকার যানজট শুধু সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার ফল নয়। আরও কারণ আছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরে সড়কের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অস্বাভাবিক। বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ কতসংখ্যক যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলাচল করতে পারে, তা বিবেচনায় না নিয়ে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে যানবাহন নিবন্ধন করা হচ্ছে বছরের পর বছর। এর পর খোলা চোখেও যেটা দেখা যায়, বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান যেমন– ওয়াসা, সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে হালের আইসিটি মন্ত্রণালয় বছরের বড় একটা সময় সংস্কারের নামে সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে নিয়োজিত থাকে। এতে নাগরিকের সেবার মান কতটা বৃদ্ধি পায়, তা দেখা না গেলেও মাঝেমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের সম্পদ ও ভাগ্যবদলের খবর সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়।

গত এক দশকে ঢাকায় পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন সড়ক হয়েছে। মেট্রোরেল, বাস রুট ট্রানজিটসহ (বিআরটি) নানা প্রকল্প দেখা গেছে। কিন্তু যানজট তো কমেনি। কিছু ক্ষেত্রে বরং বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্যানুযায়ী, ২০০৭ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। ২০২২ সালে তা কমে হয়েছে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এই গতিতে চললে ঢাকা এক সময় নিশ্চল শহরে পরিণত হবে– এ কথা বুঝতে হলে গবেষণাগারের গবেষণার ফলের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। যানজট কমাতে চাইলে এই গোড়ার সমস্যাই সবকিছুর আগে সমাধান করতে হবে। নির্ধারণ করতে হবে ঢাকা শহরে মোট কতসংখ্যক যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে, পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজনে নতুন নিবন্ধনের সংখ্যা নির্ধারিত হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে বড় আকারের বাসের সংখ্যা বাড়ানোর নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। অফিসের সময়সূচিতে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনতে হবে। ফুটপাতগুলোকে হাঁটাচলার উপযোগী এবং সড়কের দু’পাশে যানবাহন পার্কিং পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। যে শহরে মেট্রোরেল এসেছে, সেই শহরে যানজট থাকবে– এমন ব্যঙ্গাত্মক পরিস্থিতি কোনো নাগরিকেরই প্রত্যাশিত নয়। 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×