ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

সংবাদমাধ্যম

সাংবাদিকতা বাঁচাতে পারে কে?

সাংবাদিকতা বাঁচাতে পারে কে?

মশিউল আলম

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০২৩ | ০৪:৫৪

গতকাল ৮ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোয় ‘সাংবাদিকেরাই কেবল সাংবাদিকতাকে বাঁচাতে পারেন’ শিরোনামে মাহফুজ আনামের লেখা একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। কাক কাকের মাংস খায় না, এই আপ্তবাক্য মিথ্যা করে দিয়ে এ দেশে সম্প্রতি যারা স্বজাতিমাংসভক্ষণের কার্নিভাল জমিয়ে তুলেছে, তারাই যে ডেইলি স্টার সম্পাদকের নিবন্ধটির লক্ষ্যবস্তু তা বুঝতে কষ্ট হয় না। নিবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন: ‘কেউ চায় না আমরা স্বাধীন থাকি, বস্তুনিষ্ঠ থাকি এবং সত্য বলি। এখানেই আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ এবং এ কারণেই চিন্তা ও চেতনার পার্থক্য থাকলেও আমাদের সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে।’

 বিষয়টি যেন এমন যে সাংবাদিকদের মধ্যেকার ঐক্যহীনতা বা বিভেদই বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জীবনমরণ সমস্যা। তারা ঐক্যবদ্ধ হলেই সে সমস্যা কেটে যাবে, তখন সাংবাদিকতাকে বাঁচানোর জন্য আর কাউকে প্রয়োজন হবে না। মাহফুজ আনাম শিরোনামে ‘কেবল’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন এবং নিবন্ধজুড়েই কেবল বা শুধুর সুরই ধ্বনিত হয়েছে। এর ফলে তাঁর বক্তব্য খণ্ডিত বা অসম্পূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। অবশ্য বুঝতে কষ্ট হয়নি যে তিনি কথাগুলো লিখেছেন পেশাগত আপনজনদের আরও আপন করে পাওয়ার মনোবাঞ্ছা থেকে এবং সম্ভবত সে কারণে খেয়াল করেননি যে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে এই পেশাজীবীদের ‘মূল চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে একটা সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণের প্রকাশ ঘটেছে। সেখানে আর কাউকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হচ্ছে না, এমনকি সংবাদমাধ্যমের পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকেও নয়। যেহেতু অনেকেই চায় না আমরা সাংবাদিকেরা স্বাধীন থাকি, তাই কাউকেই আমাদের প্রয়োজন হবে না যদি আমরা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং ঐক্যবদ্ধ থাকি; আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না– এ রকম দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক নয় বলে আমি মনে করি।

তার মানে এটা নয় যে আমি বলতে চাচ্ছি সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন নেই। সে প্রয়োজন অবশ্যই আছে, কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন যে সাংবাদিকতা রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা বা শক্তি ‘সাংবাদিক’ নামক পেশাজীবী সম্প্রদায়ের হাতে এককভাবে নেই। প্রায়োগিক ও নৈতিক উভয় ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য। এই সম্প্রদায় কী বিষময়রূপে বিভক্ত, তা তো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে, এবং সে কারণেই তো মাহফুজ আনামের এই সনির্বন্ধ আহ্বান। কিন্তু যদি কখনও এই দেশের সব মত ও পথের সব সাংবাদিক ঐক্যবদ্ধ হনও (এটা একটি শুভকামনা, বাস্তবে সম্ভবপর বলে প্রতীয়মান হয় না), তবু তাদের পক্ষে দমনপীড়নমুক্ত স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার অধিকার সুরক্ষিত করার পর্যাপ্ত ক্ষমতা অর্জন করা কঠিন হবে।

সাংবাদিক সম্প্রদায়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়, স্বাধীন সাংবাদিকতা রক্ষা করতে সংবাদমাধ্যমের ভোক্তাদেরও প্রয়োজন। প্রয়োজন পাঠক-দর্শক-শ্রোতাকে, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের, যাদের এই জ্ঞান ও উপলব্ধি রয়েছে যে তাদের সব নাগরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রহরী হলো স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম।

রাষ্ট্র ও সমাজের সব প্রতিষ্ঠান, যা জনগণের টাকায় পরিচালিত হয়, তা সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার (তথ্য অধিকার আইন-২০০৯), এই অর্থে যে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।’

নাগরিকদের সেই মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন করা ও সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজন স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম; সংবাদমাধ্যম শক্তিশালী হয় তার ভোক্তাসাধারণের আস্থার জোরে; সংবাদমাধ্যম সেই আস্থা অর্জন করতে পারে প্রধানত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষগুলোকে জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে; জনগণের অর্থ কীভাবে ব্যয়, অপব্যয়, তছরুপ/লুট/পাচার করা হয় তা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে; ক্ষমতাপ্রাপ্ত ও ক্ষমতা কুক্ষিগতকারীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের তথ্য প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে; অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের শিকার ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের তথ্য প্রকাশ এবং তাদের বক্তব্য জাতির সামনে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে; এককথায় বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও দক্ষতাপূর্ণ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে।

কিন্তু সংবাদমাধ্যমের ভোক্তাসাধারণ দৃশ্যত একটি বিমূর্ত, অবয়বহীন সত্তা, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের (নিদেনপক্ষে কোনো অংশের) স্বর সম্মিলিতভাবে উচ্চারিত হচ্ছে। যখন বড় আকারের, স্বাধীন, শক্তিশালী এবং মৌলিক কতকগুলো বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ একটি নাগরিক সমাজ অনুপস্থিত থাকে, তখন সংবাদমাধ্যমের পাঠক, দর্শক, শ্রোতার মোট সংখ্যা যত বড়ই হোক না কেন, তার কার্যকরভাবে ক্ষমতায়িত হওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ রকম পরিবেশে যখন কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান দৃশ্যত সর্বব্যাপী ক্ষমতার অধিকারী শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে, তখন সেই সংবাদপ্রতিষ্ঠানের জন্য নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তার পক্ষে সেই রোষানল থেকে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে।

তবে পাবলিক অপিনিয়ন বা জনমত সংগঠিত করার সাংগঠনিক কাঠামোর অভাবজনিত নাজুকতার মধ্যেও কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে শাসকগোষ্ঠীর দমনেচ্ছার কবল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব, যদি ব্যাপক সংগঠিত রূপে না হলেও বিদ্যমান জনমতের বৃহদংশ ওই সংবাদপ্রতিষ্ঠানের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সমাজে সাধারণভাবে প্রতীয়মান হয়। তা ছাড়া, শাসকগোষ্ঠী কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠানকে দমন করার তৎপরতায় নামলে এর পক্ষে যে কারণ বা যুক্তি দাঁড় করায়, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে তা দুর্বল/উদ্দেশ্যমূলক/অজুহাত বলে মনে হলে এবং সেই মনে হওয়া নানাভাবে (ফিজিক্যাল ও ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যমে) পাবলিক পারসেপশনে প্রতিফলিত হলে আক্রান্ত সংবাদপ্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।

কিন্তু এগুলো স্বাধীন ও সৎ সাংবাদিকতা বাঁচানোর পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী রক্ষাকবচ নয়। সাংবাদিকদের মধ্যে অন্তত পেশাগত অধিকারগুলোর স্বার্থে ঐক্য প্রয়োজন তো বটেই, সেই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের ভোক্তাসাধারণের সম্মিলিত সমর্থন ব্যক্ত করার উপযোগী কাঠামো ও পরিসরও খুব প্রয়োজন।

মশিউল আলম: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আরও পড়ুন

×