আন্তর্জাতিক
বিশ্বে ডলারের চাহিদা হ্রাস অবশ্যম্ভাবী

পেপ এসকোবার
প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৩ | ২২:২০
এ সত্য এখন প্রতিষ্ঠিত– বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের মর্যাদা হ্রাস পাচ্ছে। ২০০১ সালে বৈশ্বিক রিজার্ভে ডলারের অংশ ছিল ৭৩ শতাংশ। ২০২১ সালে তা ৫৫ শতাংশে নেমেছে এবং ২০২২ সালে হয়েছে ৪৭ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, গত বছর ডলারের চাহিদা গত দুই দশকের গড় থেকে ১০ গুণ দ্রুত কমেছে। ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক লেনদেনে ডলারের অংশ ৩০ শতাংশে নেমে আসা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। ঠিক ওই সময়েই অনুষ্ঠিত হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডলারের সবচেয়ে পতনের ঘটনা ঘটে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন রাশিয়ান বৈদেশিক রিজার্ভের ৩০০ বিলিয়ন ডলার পশ্চিমারা ‘ফ্রিজ’ করে ফেলে। তখন পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ বিদেশে থাকা তাদের নিজস্ব ডলার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।
রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভের মতে, রাশিয়া ও চীনের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি বাণিজ্য এখন চলে হয় রুবল, না হয় ইউয়ান ব্যবহার করে। রাশিয়া ও ভারত রুপিতে তেলের ব্যবসা করছে। চার সপ্তাহেরও কম সময় আগে লাতিন আমেরিকার প্রথম ব্যাংক হিসেবে ব্রাজিলের ব্যাংকো বকম বিবিএম ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমের (সিআইপিএস) সরাসরি অংশগ্রহণকারী হিসেবে নিবন্ধন করেছে। সিআইপিএস পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আর্থিক মেসেজিং সিস্টেম সুইফট-এর চীনা বিকল্প। চীনের সিএনওওসি এবং ফ্রান্সের টোটাল কোম্পানি সাংহাই পেট্রোলিয়াম এবং ন্যাচারাল গ্যাস এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ইউয়ান তথা চীনা মুদ্রায় তাদের প্রথম এলএনজি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাও মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে। প্রথম ৩০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ ইউয়ানে হবে, তবে রাশিয়া পরেরটি রুবল তথা রাশিয়ার মুদ্রায় করার চেষ্টা করবে। রাশিয়া এবং বলিভিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এখন বলিভিয়ানোতে হবে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ওই ব্যবসাগুলোর সঙ্গে ব্রিকসের অনেক সদস্য দেশ জড়িত এবং এর বাইরের দেশও রয়েছে। অন্তত ১৯টি দেশ ইতোমধ্যে ব্রিকস প্লাস-এ যোগদানের জন্য অনুরোধ করেছে। ব্রিকস একুশ শতকের প্রধান বহুমুখী প্রতিষ্ঠানের বর্ধিত সংস্করণ, যার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা। মূল পাঁচ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে জুনের আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে নতুন সদস্যদের যোগদানের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন।
ব্রিকস এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে জি৭-এর চেয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রতিক আইএমএফের পরিসংখ্যান অনুসারে, ব্রিকসের পাঁচটি দেশ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে ৩২ দশমিক ১ শতাংশ অবদান রাখবে, আর সেখানে জি৭-এর হার ২৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকো এর সম্ভাব্য নতুন সদস্য। এটা স্পষ্ট– গ্লোবাল সাউথের (লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়া) মূল খেলোয়াড়রা পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে সক্ষম বহুমুখী প্রতিষ্ঠানের দিকে মনোনিবেশ করতে শুরু করেছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর কাছে পণ্য রয়েছে, আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন জি৭ নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ। জি৭ পণ্য উৎপাদন করতে পারে না, তবে ব্রিকস মুদ্রা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যখন তাদের মূল্য স্বর্ণ, তেল, খনিজ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে যুক্ত থাকে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অপারেশন শুরু হওয়ার পরপরই তেলের বিরুদ্ধে জি৭ যুদ্ধ ঘোষণা করে। তারা ওপেক প্লাসকে হুমকি দিয়েছিল, যাতে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। কিন্তু তারা অপমানজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ওপেক প্লাস মস্কো-রিয়াদ দ্বারা সফলভাবেই পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা বিশ্বব্যাপী তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। পশ্চিমা অভিজাতরা আতঙ্কে রয়েছে– বিশেষ করে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের সময় চীনের মাটিতে লুলার প্রস্তাবের পর, যখন তিনি মার্কিন ডলারের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব মুদ্রায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করার জন্য গোটা গ্লোবাল সাউথকে আহ্বান জানান।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্ড সম্প্রতি নিউইয়র্কভিত্তিক কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনকে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিতে পারে এবং তাতে ডলার এবং ইউরোর আধিপত্য হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।’
সাংহাই পেট্রোলিয়াম এবং ন্যাচারাল গ্যাস এক্সচেঞ্জ ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ব্যবসা শুরু করে। যে কোনো তেল উৎপাদনকারী এখন সাংহাই বাজারে ইউয়ানে তেল বিক্রি করতে পারে। এর অর্থ হলো, তেলের বাজারে ক্ষমতার কেন্দ্র মার্কিন ডলার থেকে ইউয়ানে সরে যাচ্ছে। ইউয়ানে সাংহাই এনার্জি এক্সচেঞ্জের ভবিষ্যতের তেল চুক্তির সম্পূর্ণ ব্যবহার করার মাধ্যমে পেট্রোডলারের দিন শেষ হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাব মৌলিকভাবে বৈশ্বিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পেন্টাগনের ‘ফুল স্পেকট্রাম ডমিনেন্স’ মতবাদের অন্তর্গত। তবুও এখন, এমনকি সামরিক অবস্থাও সংকটাপন্ন। যেখানে রাশিয়া হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর তার অগ্রগতি ধরে রেখেছে এবং রাশিয়া-চীন-ইরান এখন চীনের ‘ক্যারিয়ার কিলার’ মিসাইল মোতায়েনে সক্ষম।
নয়া উদারতাবাদ, নিষেধাজ্ঞা ডিমেনশিয়া এবং ব্যাপক হুমকির মিশ্রণে গঠিত পাশ্চাত্যের বৈশ্বিক প্রভাবের ভেতর থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ডলারের পতন ব্যবস্থাটির অনিবার্য পতনের একটি আলামত। একটি যুদ্ধাবস্থার মধ্যেও রাশিয়া-চীনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব যে শত্রুকে বাধা দেওয়ার কোনো তৎপরতা চালাচ্ছে না– তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ শত্রু নিজেই নিজেকে পরাস্ত করতে ব্যস্ত।
পেপ এসকোবার: ব্রাজিলিয়ান ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক, এশিয়া টাইমসের এডিটর অ্যাট লার্জ; পশ্চিম এশিয়াবিষয়ক অনলাইন সাময়িকী দি ক্রেডল থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক