ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

রাজনীতি

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও চায়ের কাপে বেহুদা ঝড়

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও চায়ের কাপে বেহুদা ঝড়

আবদুল মান্নান

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩ | ১৮:০০

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৫ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বিদেশ ছিলেন। প্রথমে জাপান, তারপর যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের সদরদপ্তরে আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন; বাংলাদেশের সঙ্গে সংস্থাটির সহযোগিতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। সব শেষে যুক্তরাজ্যে রাজা তৃতীয় চার্লসের আমন্ত্রণে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গত ৯ মে দেশে ফিরেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফর সর্বাঙ্গীণ সফল এবং সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। তবে ভিন্নমত বিএনপি ও মিত্রদের। তাদের মতে, এ সফর সম্পূর্ণ ব্যর্থ। জাপানের সঙ্গে আটটি সহযোগিতার সমঝোতা ও একটি চুক্তি স্বাক্ষর অথবা বিশ্বব্যাংকের ২ দশিমক ২৫ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন সহযোগিতার ঋণ বরাদ্দ কিছুই নয়।

শেখ হাসিনা যখন বিশ্বব্যাংকে সভা করছেন, তখন বিএনপির নেতাকর্মী বাইরে জমায়েত করে চিৎকার করছেন– ‘শেখ হাসিনার সরকারকে এক ডলার ঋণও দেবেন না। আগামীতে যখন জনগণের সরকার (?) আসবে, তাদের ঋণ দেবেন।’ বিএনপির কয়েকজন ওপরের সারির নেতা দিনের জনসভা ও রাতের টকশোতে জোর গলায় বলেছেন– শেখ হাসিনা ‘জনতার রোষানল থেকে রক্ষা করার আকুতি’ নিয়ে বিদেশিদের কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিত্যদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে নতুন নতুন সংগঠনের ব্যানার টাঙিয়ে এসব বিষয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট। বিএনপি বা তাদের মিত্রদের সমস্যা অনেক। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা– তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা।

সফরটি চলাকালে সমালোচক অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী  করছিলেন– শেখ হাসিনা হয়তো আর দেশে ফিরবেন না। তাঁদের মুখে ছাই দিয়ে সফলতার তৃপ্তি নিয়ে তিনি সহাস্যে দেশে ফিরেছেন। ফিরে কয়েক দিনের মধ্যে বেশ কয়েকটি বোমা ফাটানো বক্তব্যও দিয়েছেন। সেসব বক্তব্য নিয়ে এখন বিরোধীরা দৌড়ের মধ্যে।

দুই.

শেখ হাসিনা বলেছেন, যেসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের কাছ থেকে কিছু আমদানি করা হবে না। তিনি অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছেন। র‍্যাবের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর গত বছর হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটি। কেন র‍্যাবের ওপর এই স্যাংশন? উত্তর দিতে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য নয়। বরং এমন ধারণা তৈরি হয়েছে– তারা সবার ওপর খবরদারি করবে। এটি তাদের অধিকার।

র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ– তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এ খবর যুক্তরাষ্ট্রকে কে দিল? যারা দিল তাদের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? তারাই কি ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতের তাণ্ডব বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপে কয়েক হাজার মাদ্রাসাছাত্র নিহত হওয়ার তথ্য আবিষ্কার করেছিল? তাদের মধ্যে ওইসব সংগঠনও আছে, যারা প্রশ্নবিদ্ধ বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে চলে। মূল কর্মকাণ্ড আড়ালের জন্য তারা বেশ কিছু ভালো কাজেও অর্থায়ন করে। সবই হয় গণতন্ত্র টেকসই করার নামে। র‍্যাবের সৃষ্টি ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। তারাই প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্রের জোগান দিয়েছে।

জঙ্গিবাদ দমনে র‌্যাবের সাফল্য প্রশ্নাতীত। তাদের মধ্যে যারা আইন লঙ্ঘন করছে, তাদের সাজাও হচ্ছে। সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ও বাদ যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কেন এমন একটি বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল? তারা কি চায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের চাষ হোক? তাহলে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে আরেকটি আফগানিস্তান বা সিরিয়া বানানো সহজ হয়!

বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। ১৯৭৪ সালে পরপর তিনটি ফসল নষ্ট হয় ভয়াবহ বন্যায়। দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব। পাশে এসে দাঁড়ায় জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। তাদের সামর্থ্য সীমিত। বাংলাদেশের কাছে বিদেশ থেকে খাদ্য ক্রয়ের অর্থ নেই। কিউবার কাছে দেশের গুদামে রাখা ৪০ হাজার বেল পাট বিক্রি করে যদি কিছু অর্থ পাওয়া যায়।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মনে হলো, বাংলাদেশকে তাদেরও কিছু সাহায্য দেওয়া উচিত। তাদের ‘পিএল-৪৮০’ কর্মসূচির অধীনে চাল ও গম নিয়ে দুটি জাহাজ চট্টগ্রামের উদ্দেশে সে দেশের বন্দর ত্যাগ করল। পথে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট খবর পেল– কিউবার কাছে পাট বিক্রি করেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে কয়েকশ নটিক্যাল মাইল দূরে থেকেই ফিরে গেল জাহাজ। তাদের ‘শত্রু’-দেশের কাছে পাট বিক্রি যেন ভয়াবহ অপরাধ! খাদ্য নিয়ে এই নির্মম রাজনীতি করা দেশটির মুখেই এখন মানবাধিকারের কথা? কিন্তু ১৯৭৪ সাল আর ২০২৩ সালের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক তফাত।

তিন.

যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয়টি দেশের ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের বাড়তি নিরাপত্তায় তাঁদের গাড়ির সামনে-পেছনে হুইসেল বাজিয়ে প্রটোকল দেওয়া হতো। তা প্রত্যাহার করা হবে। তাঁরা যদি বাড়তি নিরাপত্তা নিতে চান, তাহলে খরচ বহন করতে হবে। বাংলাদেশে ৭০টির বেশি দেশের দূতাবাস আছে। তাদের যদি বাড়তি নিরাপত্তা দিতে না হয়, তাহলে কয়েকটি দেশের কর্মকর্তাকে কেন দিতে হবে?

বাড়তি নিরাপত্তা প্রয়োজন হয়েছিল হলি আর্টিসানের ঘটনার পর। সেই পরিস্থিতি তো এখন নেই। সিডনিভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পিস সম্প্রতি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ২০২২ সালের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশ এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি শান্তিপূর্ণ; এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক গুণ ভালো। এই সূচকে ভারত ১৩তম, যুক্তরাষ্ট্র ৩০তম, যুক্তরাজ্য ৪২তম আর বাংলাদেশ ৪৩তম।

দুই দশকে আমার সুযোগ হয়েছে বহির্বিশ্বে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয় যাওয়ার। কোথাও ওই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি দেখিনি। দিল্লিতে বাংলাদেশের এত বড় দূতাবাসে দু’জন পুলিশ গেট পাহারা দেয়। কোথাও হাইকমিশনার বা রাষ্ট্রদূত বের হলে তাঁর আগে-পিছে পাহারা বা তথাকথিত প্রটোকল থাকে না। ২০১৮ সালে দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হলে লন্ডনে এক দল দুর্বৃত্ত আমাদের দূতাবাসে প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে চারদিকে ছি ছি পড়ে যেত। ওদের কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না।

বাংলাদেশে কোনো কিছু ঘটলে ওয়াশিংটনে বসে থাকেন খালেদা জিয়ার একজন সাবেক সহকারী প্রেস সচিব। তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলেন। প্যাটেল বেশ জুতসই উত্তর দিয়ে বললেন, একটি দেশে অন্য দেশের দূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী সে দেশের সরকারের।

ভিয়েনা কনভেনশনের ২৯ ধারায় বলা আছে– এক দেশের দূতকে তাঁর কর্মস্থলে সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে সে দেশ (হোস্ট) বাধ্য থাকবে। এটি তো বাংলাদেশ সবসময় দিয়েছে বা দেবে। দিল্লির কূটনৈতিকপাড়ার নাম চাণক্যপুরী। সেখানকার সড়কগুলো জনসাধারণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা চোখে পড়ার মতো। ঢাকার কূটনৈতিক এলাকা বারিধারা সবসময় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা চাদরে ঢাকা থাকে। রাতে চলাচল তো সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত।

ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারায় লেখা আছে– দূতাবাসের সব কর্মকর্তা (রাষ্ট্রদূতসহ) যে দেশে তাঁদের কর্মস্থল, সে দেশের আইনকানুন মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন। তাঁরা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। কনভেনশনে আরও বলা হয়েছে– সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া দূতাবাসের কর্মকর্তাদের চলাচলের স্বাধীনতা দিতে হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত যে কোনো সময় যে কোনো জায়গায় যেতে পারেন। তাঁদের তো কেউ বাধা দেয়নি। যদি বলা হয়, নিরাপত্তার খাতিরে স্থানীয় প্রশাসন বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে যাওয়াটা প্রত্যাশিত– তা কি খুব অন্যায়? কোনো দূতাবাসের কর্মকর্তা যদি স্বাগতিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কিছু করেন, তাহলে তাঁকে প্রত্যাহার করে নিতে বলা যাবে– এমন কথাও ভিয়েনা কনভেনশনে আছে (ধারা ৯)।

নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যথার্থ। চারটি কূটনৈতিক মিশন থেকে বাড়তি নিরাপত্তা তুলে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের বা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হয়নি। সবার নিরাপত্তা বহাল আছে। এসব বিষয় নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তোলার কোনো কারণ নেই।

আবদুল মান্নান: বিশ্লেষক ও গবেষক

আরও পড়ুন

×