ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

স্মরণ

তিক্ত কথাও মিষ্টি করে বলতে শিখিয়েছেন তিনি

তিক্ত কথাও মিষ্টি করে বলতে শিখিয়েছেন তিনি

আসাদ চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৩ | ১৮:০০

দে  খতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল! লেখক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, প্রিয় গাফ্‌ফার ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর ১৮ ঘণ্টা আগে। কান্নাকাটি করছিলেন সমানে। বিনু– আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর কন্যা, তার বাবার সঙ্গে থাকত। মেয়েটি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল; তবু পিতৃসেবা করে গেছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সেই বিনুর মৃত্যু সংবাদ গাফ্‌ফার ভাই পেয়েছিলেন হাসপাতালে শুয়ে। দুঃসংবাদটি শুনে গাফ্‌ফার ভাইকে ফোন করেছিলাম। ২৫ মিনিটের টকটাইম কেনা ছিল; এর মধ্যে ২২ মিনিট গাফ্‌ফার ভাই শুধু কাঁদলেন। মেয়ের অকালমৃত্যু বাবাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলেছিল।

গত বছর ১৯ মে গাফ্‌ফার ভাইয়ের মৃত্যুর দু’দিন আগে ঢাকা থেকে টরন্টো এসে পৌঁছেছিলাম। যে কারণে ঢাকায় তাঁর জানাজা ও দাফনে থাকতে পারিনি। আগের রাতেও তাঁকে ফোন করেছি। রিংটোন বেজেই চলেছে; কেউ রিসিভ করেনি। ধরে নিয়েছিলাম, অসুস্থতার কারণে তিনি ফোন রিসিভ করতে পারছেন না। পরদিন এসেছিল তাঁর মৃত্যু সংবাদ। গাফ্‌ফার ভাইকে নিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য সমকালের সাংবাদিক মিজান শাজাহান আমাকে ফোন করেছিলেন। কথা বলতে পারিনি। ঢাকা থেকে কানাডা পর্যন্ত উড়োজাহাজ ভ্রমণের ক্লান্তি তো ছিলই; কিন্তু শরীরের ক্লান্তির চেয়ে অভিভাবক হারিয়ে মানসিক ক্লান্তি ছিল অনেক বেশি।

গাফ্‌ফার ভাই নেই– এখন এ কথা ভাবতেই বুকের মধ্যে খাঁখাঁ করে। তাঁর মতো বড় মনের মানুষ হারানোর ক্ষতি কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়। তিনি আমাকে সংবাদপত্রে চাকরি দিয়েছেন। তাঁর কল্যাণেই সাংবাদিক হিসেবে নিজের নাম লেখানোর সুযোগ হয়েছে। তিক্ত কথাকে কীভাবে মিষ্টি করে বলা যায়, তা গাফ্‌ফার ভাইয়ের কাছে শিখেছি।

গাফ্‌ফার ভাই কিছু ব্যক্তিগত কথা বলেছিলেন আমাকে। তিনি অনেক ডায়েরি লিখেছেন। আমাকে বলেছিলেন, তুমি এগুলো সংগ্রহ করো। আরও বলেছিলেন, আমি যেন তাঁর মৃত্যুর পরে বা সম্ভব হলে আগে সেসব সম্পাদনা করে প্রকাশের ব্যবস্থা করি। আমার লন্ডনে যাওয়াই হয়নি; কভিডের বিধিনিষেধের কারণে তখন কানাডায় আটকা। জানি না, তাঁর অনুরোধ রাখতে পারব কিনা। তখন তো তাঁর কাছ থেকে ডায়েরিগুলো বুঝে নিতে পারিনি। আবার তাঁর সব বিষয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী বিনুও পরপারে। আমিও বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে কানাডায়। এ অবস্থায় সেসব ডায়েরির সন্ধান কীভাবে পাব, বুঝতে পারছি না।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গেলে উলানিয়া এবং নদীর কথা বলতেই হবে। গাফ্‌ফার ভাই এবং আমাদের গ্রামের নাম উলানিয়া। বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া মেঘনা নদীর ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হয়েছিল। ২০০৩ সালে হঠাৎ শুরু হওয়া অস্বাভাবিক ভাঙনে উলানিয়ার পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর ইউনিয়ন পুরোপুরি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। উলানিয়া ব্রিটিশ আমল থেকেই সমৃদ্ধশালী। এখানে যেমন দেড়শ বছরের পুরোনো জমিদারবাড়ি, মসজিদ, দিঘি রয়েছে; তেমনি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসাকেন্দ্র আছে।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, আমার পাশাপাশি উলানিয়ায় জন্মেছেন প্রখ্যাত নাট্যকার আতিকুল হক চৌধুরী, ভাষাসংগ্রামী বাহাউদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু বরিশালে বাকশালের গভর্নর করেছিলেন আমাদের বাড়ির আমিনুল হক চৌধুরীকে। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক তাঁর কন্যাকে বিয়ে দিয়েছেন উলানিয়ার মৌলভী বজুলর রহিম চৌধুরীর কাছে। তরুণ প্রজন্মের কয়জন জানেন জানি না, এই বজলুর রহিম ‘সোহরাব-রুস্তম’ কাব্যের রচয়িতা।

মেহেন্দীগঞ্জ একটি দ্বীপ উপজেলা। উলানিয়া যখন নদীভাঙনের শিকার হয়, তখন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী বিরাট ভূমিকা রাখেন। দেশপ্রেম না থাকলে এ ধরনের ভূমিকা নেওয়া যায় না। অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাড়ি জমিয়ে সেখানে স্থায়ী বসবাস করলেও নিয়মিত, বলা চলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেশের খোঁজখবর রাখতেন। দেশ ও মানুষ নিয়ে ভাবতেন। আর তাই ঢাকার ৫-৬টি দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন। লেখার মুনশিয়ানার কারণে সর্বাধিক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।

দেশ নিয়ে যেমন ভাবতেন, তেমনি তাঁর গ্রাম নিয়েও ভাবতেন। মনে আছে, আমাদের উলানিয়া করোনেশন হাই স্কুলের শতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানের (২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর) অতিথি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন– আমার বাবা-মায়ের কবর রক্ষার্থে ব্যবস্থা নিন। আমি যে মাঠে শৈশবে ফুটবল খেলেছি, তা রক্ষার্থে বাঁধ দিন।

২০১২ সালে আমাদের স্কুলের শতবর্ষ পূর্ণ হয়। ২০১১ সালে গাফ্‌ফার ভাই আমার কাঁধে চাপিয়ে দিলেন শতবর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব। মুশকিলটা ছিল, সে সময় নদীভাঙনের চূড়ান্ত পর্যায় চলছিল। অঙ্ক করে দেখলাম, ওই সময় যদি আমরা অনুষ্ঠান করি, গান-বাজনা করি আর এদিকে নদী ভাঙে; লোকে অপছন্দ করবে। তাই অনুষ্ঠানটি পিছিয়ে দিলাম।

ওই সময় গাফ্‌ফার ভাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সময় দিয়েছিলেন বোধ হয় ২০ মিনিট। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ করলেন আড়াই ঘণ্টার বেশি। গাফ্‌ফার ভাই তিন-চারবার বললেন– মা, আমার গ্রামটা বাঁচাও। তখন প্রধানমন্ত্রী ভরসা দিলেন– চাচা, আমি বেঁচে থাকতে আপনার গ্রাম ভাঙতে দেব না। প্রধানমন্ত্রী কথা রেখেছেন। ৩৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করে দিয়েছেন। এর পর গাফ্‌ফার ভাই ঢাকা এসেছেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল উলানিয়ার বাঁধ দেখতে যাওয়ার। কিন্তু অসুস্থতার কারণে সেই ঝুঁকি নেওয়া হয়নি।

একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি’­র রচয়িতা হিসেবে গাফ্‌ফার ভাই সর্বাধিক পরিচিত। শেষ জীবনে জনিপ্রয়তার তুঙ্গে উঠেছিলেন রাজনৈতিক কলাম লেখক হিসেবে। এসব পরিচয়ের বাইরে তিনি একজন লেখক, সাহিত্যিক ও কবি। তাঁর লেখা ‘লালগঞ্জের তীরে সূর্যোদয়’ পড়লে বোঝা যায়, কবিতা রচনা অব্যাহত রাখলে তিনি কবি হিসেবেও খ্যাতি পেতেন।

আসাদ চৌধুরী: কবি

আরও পড়ুন

×