রাজনীতি
ইশতেহারে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নির্বাচনে সুফল দেবে?

অজিত কুমার সরকার
প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ পায় রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি, নীতিগত অগ্রাধিকার এবং জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলার প্রস্তাবগুলো। অর্থনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানো, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবেশ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন, দুর্নীতি হ্রাস ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মতো অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা মুদ্রিত ও লিখিত আকারে ইশতেহারে প্রকাশ করা হয়ে থাকে, যাতে ভোটাররা দলের দৃষ্টিভঙ্গি ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তবে এসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে যদি চমক থাকে, তা ভোটারদের আলাদা মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং দলের বিজয়ের অন্যতম নিয়ামক হয়ে ওঠে।
২০০৮ সালে ৯ম জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগের ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারের কথাই ধরা যাক। এ ইশতেহারে প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে বড় চমক ছিল রূপকল্প (ভিশন) ২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগই প্রথম, যারা নির্বাচনী ইশতেহারে সময় নির্দিষ্ট করে রূপকল্প ঘোষণা করে, যার মূল উপজীব্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এই ঘোষণা দেশের মানুষ বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে দারুণভাবে অনুরণন তোলে। ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ওই নির্বাচনে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী তরুণ ভোটার যাঁদের সংখ্যা প্রায় ২২ শতাংশ, তাঁদের ভোট টানতে সহায়তা করেছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা। আওয়ামী লীগের এই ভূমিধস বিজয়েরও অন্যতম ফ্যাক্টর ছিল ওই তরুণ ভোটার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আসছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। গত ১৫ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টতই তা জানিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন জাগতে পারে– চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যখন চাকরি হারানোর ঝুঁকি, সব মানুষকে ডিজিটালি লিটারেট করাসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তখন পুনরায় ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ তা কীভাবে মোকাবিলা করবে? স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি পূরণে তা কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করবে কিনা?
প্রথমত, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশে গ্রাম পর্যন্ত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। দেশের প্রায় শতভাগ এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে এবং নতুন প্রযুক্তি বোঝা একটা শ্রেণি গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, দেশে এখন আর কোনো প্রযুক্তির বিরোধিতাকারী দল নেই। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মেবাইল ফোনের মনোপলি ব্যবসার সুযোগ দিয়ে তা গুটিকয়েক মানুষের ব্যবহারের মধ্যে সীমিত রাখা হয়েছিল। সেই সময়ে যারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে রেখেছিল তারাও এখন ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার করছে। লক্ষণীয়, ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু হলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ নিয়ে সমালোচনা ও কটাক্ষ করেছিল। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত তেমনটি শোনা যাচ্ছে না। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এটা এক ইতিবাচক দিক। এ কথা অনস্বীকার্য, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ অগ্রসর প্রযুক্তির আবির্ভাবে চাকরি হারানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে যারা অদক্ষ বা স্বল্প দক্ষ তাদের হয়তো চাকরি যাবে, কিন্তু চাকরি হারানো মানুষের চেয়ে দক্ষ মানুষের চাকরি হবে দ্বিগুণ।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চেই আইসিটি বিভাগ জাইকার সহায়তায় খসড়া ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: আইসিটি ২০৪১ মাস্টারপ্ল্যান’ প্রণয়ন করেছে। পরবর্তী সময়ে তা আরও সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়। এতে স্মার্ট বাংলাদেশের চার স্তম্ভের আলোকে ৪০টি মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা অনুসারে এনহ্যান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই)সহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা, উদ্ভাবন ও স্টার্টআপের বিকাশ ঘটানোর নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। ইতোমধ্যে অগ্রসর প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য স্মার্ট ডিজিটাল লিডারশিপ একোডেমি গড়ে তোলা হয়েছে। চলতি মাসে সংসদ সদস্যদের নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট লিডারশিপ শীর্ষক ওয়ার্কশপের আয়োজন করছে ইডিজিই প্রকল্প। এটি এক ইতিবাচক উদ্যোগ। কারণ সংসদ সদস্যরাই স্থানীয় পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্য থেকে স্মার্ট লিডারশিপ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
আশার কথা, এসব উদ্যোগে গুরুত্ব পাচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানোর বিষয়। যেমন স্মার্ট সিটিজেন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ মানুষ তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্মার্ট অর্থনীতিতে ২০৪১ সাল নাগাদ আইসিটি খাতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত করা এবং জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আইসিটি খাতের অবদান অন্তত ২০ শতাংশ নিশ্চিত করা। স্মার্ট গভর্নমেন্ট স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার পাশাপাশি একজন সেবাগ্রহীতার সময়, অর্থ এবং যাতায়াত (টিসিভি) সাশ্রয় করতে সহযোগিতা করবে। প্রশাসন হবে কাগজহীন। আর স্মার্ট সোসাইটির লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। আর্থিক সেবাসহ ডিজিটাল মাধ্যমগুলোয় সব মানুষের অন্তর্ভুক্তিতা নিশ্চিত করা হবে।
আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। এর কারণ, দলগুলো যা প্রতিশ্রুতি দেয় তা পূরণ করে না। ব্যতিক্রম ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি। এখন দেখার অপেক্ষা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের এজেন্ডা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে দলটির বিজয়ে কতটা প্রভাব ফেলে।
অজিত কুমার সরকার: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
- বিষয় :
- রাজনীতি
- অজিত কুমার সরকার