রাশিয়া
প্রিগোজিনের বিদ্রোহের নেপথ্যে সিআইএ?

এম কে ভদ্রকুমার
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৩ | ১৮:০০
সিএনএনের পর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে রোববার প্রকাশ হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের ব্যর্থ ক্যু সম্পর্কে অবহিত ছিল। শুক্রবার রাতে রুশ ভাড়াটে সেনা দল ওয়াগনার বিদ্রোহ করে। আমরা যা জানি না তা হলো, রুশ গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি সম্পর্কে কতটা ওয়াকিফহাল ছিল। তবে ক্রেমলিন যথাসময়েই শক্ত হাতে বিদ্রোহ দমন করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। শনিবার বিকেলে বিদেশি গোয়েন্দাপ্রধান সের্গেই নারিশকিন ঘোষণা করেন, ক্যু চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
এটা খুবই স্বাভাবিক, রুশ গোয়েন্দারা ওয়াগনারের তাঁবুতে সবসময় শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রেখেছিল। স্টিং-এর বিখ্যাত গানের কথা এখানে মনে আসে: ‘প্রতিটি নিঃশ্বাস তুমি গ্রহণ করো/ এবং প্রতিটি পদক্ষেপ তুমি তৈরি করো/ প্রতিটি বন্ধন তুমি ভাঙছ/ প্রতিটি পদক্ষেপ তুমি নিচ্ছ/ আমি তোমাকে দেখছি...।’
এর পর এখানে কোরাস গানের কথাও প্রাসঙ্গিক: ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না/ তুমি আমার?/ আমার কোমল হৃদয়ে বেদনা জাগায়/ তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ...।’
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কিংবা অধিকাংশ গোয়েন্দা সংস্থা এমনটাই করে। রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি তা-ই করেছে। এটা তাদের নিয়মিত কাজ এবং এ কাজে তাদের প্রশিক্ষিত লোক রয়েছে। তাদের চোখে দোনেৎস্কে প্রিগোজিনের গত শরতের তৎপরতা এড়ানোর কথা নয়। এর পর শীত শুরু হয়েছিল বাখমুতের যুদ্ধের মাধ্যমে। আশ্চর্যের বিষয়, যে লোক বাখমুতের যুদ্ধে নেত্বত্ব দিয়েছিলেন, তিনিই কিনা উপসংহার টানেন– দনবাস বা রাশিয়ার প্রতি কিয়েভ (ইউক্রেনের রাজধানী) বা ন্যাটোর খারাপ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।
প্রিগোজিনের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ যে চুক্তি করা হয়েছে তা হলো, তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে না; বরং বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সুতরাং তাঁর নির্বাসন বেলারুশ ছাড়া আর কোথায় হতে পারে, যেখানে তিনি প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর সুনজরে থাকবেন?
প্রিগোজিনের বিদ্রোহের ঘটনায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, রাশিয়া যখন ওয়াগনার বাহিনী দমনে কাজ করছিল, তখন লুকাশেঙ্কো সাবেক কাজাখ স্বৈরশাসক নুরসুলতান নাজারবায়েভের সঙ্গে সমঝোতায় ব্যস্ত ছিলেন। নাজারবায়েভ কাজাখস্তানে পশ্চিমা সমর্থিত শাসক ছিলেন এবং পরে পশ্চিমা সমর্থিত এক ক্যুর পরিণামেই ক্ষমতা থেকে উৎখাত হন।
বস্তুত এর আগের দিন পুতিন মধ্য এশিয়ার দুই নেতা কাজাখ প্রেসিডেন্ট জোমার্ট তোকায়েভ ও উজবেক প্রেসিডেন্ট শাভকাত মিরনভিচ মির্জিয়োয়েভের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি কি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ গোপন কিছু বলেছিলেন? বাস্তবতা হলো, এ দুই দেশই সম্প্রতি শাসন পরিবর্তনের জন্য পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে।
এরই মধ্যে রোববার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন এবিসি রেডিওতে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা খেয়াল করার মতো। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়ার বিদ্রোহের বিষয়টি এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আমি সেটা কল্পনা করতে চাই না এবং চূড়ান্ত এপিসোড দেখব বলে আমার মনে হয় না।’ যদিও রাশিয়ার ব্যাপারে ব্লিংকেনের মূল্যায়ন গুরুতর ভুল। শুরু থেকেই তারা ভেবেছিল, নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে ধ্বংস করবে; পুতিনের ক্ষমতা নড়বড়ে হবে; ইউক্রেনে রাশিয়ার বিপর্যয়কর পরাজয় হবে; রাশিয়ায় সেনা ঘাটতি দেখা দেবে; কিয়েভের বিজয় হবে ইত্যাদি।
সে জন্য রুশদের মধ্যকার ঐক্য এবং পুতিনের ভালো অবস্থান ব্লিংকেনের জন্য বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুতিনের রাজনৈতিক অবস্থান বর্তমানে রাশিয়াতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অপ্রতিরোধ্য। এমনকি জো বাইডেন দৃশ্যপট থেকে যখন বিদায় নেবেন, তারপরও আমেরিকানদের ওই বাস্তবতা মেনে চলতে হবে।
ক্রেমলিন খুবই পরিকল্পিত কিছু কৌশল গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে রক্তপাত এড়ানো। এমনকি প্রিগোজিনের বিদ্রোহ যেভাবে রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে, সেটাও উল্লেখযোগ্য। এসব কৌশল রুশদের এগিয়ে রাখছে। জেনে রাখবেন, আজ হোক কাল হোক; লুকাশেঙ্কো শেষ পর্যন্ত প্রিগোজিনকে মুখ খুলতে বাধ্য করবেন, যা আবার সরাসরি ক্রেমলিনে শোনানো হবে। তখনই ওয়াশিংটন পুরো ঘটনায় কতটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে, তা বোঝা যাবে। রাশিয়াকে অস্থিতিশীল করতে সিআইএর চক্রান্ত থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য তারা পারমাণবিক যুদ্ধ ইত্যাদি প্রসঙ্গ টেনে আনছিল।
এখন নিশ্চিতভাবে এটা বলা যায়, সিআইএ-এমআই৬ (ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা)-প্রিগোজিনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও এই ঘটনার ধ্বংসাবশেষ থেকে ফিনিক্সের জন্মের মতো পশ্চিমারা হয়তো নতুন বয়ান বাজারে ছাড়বে। ভারতসহ বিদেশে পশ্চিমা সমর্থক সংবাদমাধ্যম সেটাই প্রচার করে বেড়াবে। কিন্তু তা কত দিনই বা চলবে! মনে রাখতে হবে, ইউক্রেন সংকটের সমাধান রয়েছে ক্রেমলিন ও পুতিনের হাতে। পুতিন গত সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ তখনই শেষ হবে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় কোনো সেনাবাহিনী কিংবা ন্যাটোর অস্ত্র থাকবে না।
গত বৃহস্পতিবার পুতিন যে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন, তার দাপ্তরিক প্রতিলিপি পড়ে দেখুন। প্রিগোজিন বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর রুশ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মত যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানেই স্পষ্ট ক্রেমলিনের মনোভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে। সেখানেই আগাম ইঙ্গিত আছে যে, পশ্চিমাদের এসব চেষ্টার কিছুই ভোলা হবে না।
এম কে ভদ্রকুমার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ইন্ডিয়া পাঞ্চলাইন থেকে সংক্ষেপে ভাষান্তরিত
- বিষয় :
- রাশিয়া
- এম কে ভদ্রকুমার
- সিআইএ