স্মরণ
রশীদ হায়দারের জন্মদিন, সাহিত্যই যাঁর জীবন

রশীদ হায়দার - সংগৃহীত
দাউদ হায়দার
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
ডাকনাম শামিমা। আমরা বলি শামু আপা। সংক্ষিপ্তকরণ। আমাদের একমাত্র ফুফাতো বোন। বয়স নব্বই হতে দেরি নেই। এখনও দিব্যি সুঠাম। সচল।
ভালো নাম শামসুন নাহার। স্বামী মকবুল হোসেনের পদবি নেননি। মকবুল সংবাদপত্রে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ আমলেও। গত হয়েছেন বছর কয়েক আগে। শামসুন নাহারই একমাত্র বোন (হোক কাজিন) গল্প লিখতেন নিয়মিত। পাকিস্তান আমলেই ‘সিঁদুরে মেঘ’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত। জনপ্রিয়। বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করেছেন। বেরিয়েছে গ্রন্থাকারে।
লেখা কেন ছেড়ে দিলেন? গুরুতর কষ্ট পেয়েছেন মনে। পাকিস্তান আমলে মনোরম বাড়ি করেছিলেন মিরপুরে। ১৯৭১-এ মার্চের পরে পাকিস্তানি বাহিনীসহ বিহারিকুল তার বাড়ি পুড়িয়ে যজ্ঞে মেতেছিল।
শামসুনই (সম্ভবত) পাকিস্তান (পূর্ব) আমলে প্রথম মহিলা গ্রন্থাগারিক। ছিলেন ঢাকা আর্ট কলেজে (পরে ঢাকা কলেজে)। আর্ট কলেজে থাকাকালীন চমৎকার স্মৃতি। ঝালিয়েছেন। শুনেছি। তাঁকে জয়নুল আবেদিন, আবুল বাসেত, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী প্রমুখ শিল্পী স্নেহবশত বড় বড় ছবি উপহার দিয়েছেন। সবই ছিল মিরপুরের বাড়িতে। পোড়ায় পাকিস্তানি সেনা, পাকিস্তানি দোসর বিহারি দল। বলেন, ‘ছবিগুলো বাড়ির চেয়েও কম সম্পদ ছিল না। সবই হারিয়েছি।’ হারানোর বেদনার্ত স্মৃতি এখনও জাগরূক, চোখেমুখে।
আমাদের দোহারপাড়ার (পাবনা) বাড়িতে সাহিত্যের বীজ বপনকারী ছোট চাচা আবুল কাশেম। নাট্যকার। রসিকতা করতুম: কলকাতা থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। ঠিক, কলকাতা রঙ্গালয়ে নিজেকে সঁপে দিতে চেয়েছিলেন। কর্মীও ছিলেন। দেশভাগে পাবনায়।
পাবনার বনমালী ইনস্টিটিউটে তাঁর রচিত নাটক মঞ্চস্থ। নাট্য পরিচালনায় পোক্ত হননি তেমন। কিন্তু দোহারপাড়ার বাড়িতে নাটক চারিয়ে দিয়েছেন (বাড়ির উঠানে মঞ্চ নাটক)। হাওয়া সংক্রামক, ব্যাধির লক্ষণ। শামসুন নাটক লেখেননি কিন্তু অনুজ রোউফকে উৎসাহিত করেছেন। রোউফ কবিতা মকশো করেন। ছাপাও হয় ঢাকার পত্রপত্রিকায়। রোউফের ভালো নাম জিয়া হায়দার।
শামু আপার পরবর্তী টার্গেট দুলাল। সাকসেসফুল। ‘দুলাল কবিতা লিখতে পারে না, গল্প-উপন্যাস লিখলে খুব নাম করবে।’ তো, দুলালকে তাতানো। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ম্যাগাজিনে গল্প লিখলেন দুলাল। ওঁর কোনো গল্পগ্রন্থ যোগ হয়নি। দুলালই রশীদ হায়দার।
দুলাল কবিতাও লিখেছেন, ‘খাঁচায়’ উপন্যাসে যুক্ত।
আমরা আট ভাই, আট বোন। বড় আপা রিজিয়াকে ছাড়া শামু আপা প্রত্যেককে ডাকনামে সম্বোধন করেন।
জিয়া হায়দারকে রোউফ। রশীদ হায়দারকে দুলাল। তাঁর অনুজ/অনুজা কেউ আর বলবে না, ‘দুলাল অকালে চলে গেল। ঝরা (দুলালের স্ত্রী। আনিসা হায়দার) আগে। আমার অনুজ/অনুজা কেন আমাকে একা রেখে যায়?’ তাঁর হাহাকার। বুকে বাজে।
আটচল্লিশ বছর নির্বাসনে। দেশ-আত্মীয়পরিজনহীন।
জীবনধারণে রশীদ কতটা সংগ্রামী অনেকের অজানা। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে পড়ে ঢাকায়। পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরি পত্রপত্রিকায়। কখনও প্রুফ রিডার। কখনও রিপোর্টার। পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের পত্রিকা ‘পরিক্রম’। সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। রশীদ সহযোগী। সামান্য বেতন। পড়েন বাংলা বিভাগে। নীলিমা ইব্রাহিম, মুনীর চৌধুরীর স্নেহধন্য। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মুনীরের একটি নাটকে অভিনেতা।
চাঁদভাই (অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা)-এর মুখে শুনেছিলুম একবার: ‘রশীদ অভিনয় করলে অনেকের পান্তাও জুটত না। বলেছিলাম চলচ্চিত্রে আসতে।’
ওঁরই কথা: ‘পিটার উস্তিনভ লেখক, নাট্যকার, অভিনেতাও।’
রশীদ এক অঙ্গে নানারূপের পেখম মেলতে নারাজ। গোঁ ধরেছেন লেখক হবেন। লেখাই ধ্যানজ্ঞান।
সংগ্রামী জীবন। রাজনীতির ময়দানে প্রত্যক্ষ যোগ দেননি। পরোক্ষে আস্থাশীল। সাম্যবাদে। মানবাধিকারে। বলতেন: ‘সব মানুষই মূলত প্রেমিক। সব মানুষই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতিক। প্রকাশ্যে বা গোপনে।’
জীবিকার তাগিদে, ছাত্রাবস্থা থেকেই চাকরি। সামান্য বেতন। লক্ষণীয়, চাকরি তথা কাজ পত্রপত্রিকা কেন্দ্রিক। সাংবাদিক নন। প্রুফ রিডার থেকে শুরু করে সম্পাদক। ‘বই’-এর সহকারী সম্পাদক। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে সহপরিচালক। পরে পরিচালক। বই-এর সম্পাদকতা। কৃষি ব্যাংকেও চাকরি একদা। পাবলিক রিলেশনসে। দায় ব্যাংকের পত্রিকা সম্পাদনা।
বাংলা একাডেমির সাহিত্যপত্র ‘উত্তরাধিকার’-এর প্রথম সম্পাদক। তখন একাডেমির উপপরিচালক।
‘স্মৃতি ৭১’ সম্পাদনাকালে শিউরে উঠেছেন। বলছিলেন একবার: ‘লেখকদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। বহু মুক্তিযোদ্ধার চিঠি পড়ে, সংগ্রামের দুঃখকষ্ট বীরত্ব জেনে চোখে জল এলেও গর্বিত। ওঁদের জন্যেই বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা। তোমায় ভালোবাসি। আমৃত্যু বাসব।’ খেদহীন ভালোবাসা। মৃত্যু ১৩ অক্টোবর ২০২০। অসুখে। জন্ম ১৫ জুলাই ১৯৪১, দোহারপাড়া, পাবনায়। মা রহিমা খাতুন: (দোহারপাড়ার ডায়লগে) ‘দুলালের জন্মদিনে খুব ঝড় হইছিলে, আমগাছের ডাল ভাংগে পড়িছিলে, নারকেল গাছের কচি ও ঝুনা নারকেলও।’
দাউদ হায়দার: কবি
- বিষয় :
- স্মরণ
- দাউদ হায়দার