ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

মার্কিন প্রতিনিধি দল

জনপ্রত্যাশাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন উজরা জেয়া

জনপ্রত্যাশাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন উজরা জেয়া

এম. হুমায়ুন কবির

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সফরটির গুরুত্ব রয়েছে বেশ কিছু কারণে। বাংলাদেশে এখন যে অস্বাভাবিক একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে, বিশেষত নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, তা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা, শ্রম আইন– এসব বিষয়ে যেমন অভ্যন্তরীণ আলোচনা আছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের আলোচনায়ও স্থান পেয়েছে। মোটা দাগে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন উপাদান নিয়ে এখানে যে সংকট বিরাজমান, সেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরেকবার তিনি পরিষ্কার করে গেলেন।

উজরা জেয়া স্পষ্ট করে বলেছেন, এখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দরকার, সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা দরকার, আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুসরণ করা দরকার; নাগরিকের অধিকার যাতে রক্ষিত হয়, নাগরিকের গণতান্ত্রিক চর্চা যাতে ব্যাহত না হয়। সর্বোপরি একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যাতে অনুষ্ঠিত হয় তা নিশ্চিতে করণীয়তে তিনি জোর দিয়েছেন। কোন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছিল, ভিসা নীতি দেওয়া হয়েছে– এসব বিষয় একই অবস্থার নিরিখে মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি বলেছেন, আমরা চাই এসবের মধ্য দিয়ে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনা অর্থাৎ সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হোক। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৫২ বছরের সম্পর্ক। আজ থেকে আরও ১০-১৫ বছর পরে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে তারা যেখানে, যেভাবে দেখতে চায়; তা এসব আলোচনার মধ্যে ফুটে উঠেছে।

যুক্তরাষ্ট্র আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। তারাও আমাদের এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মনে করে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবে– এই বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিবেচ্য। রোহিঙ্গা ইস্যুটি যেভাবে বাংলাদেশের জন্য একটি ঝুঁকি হয়ে পড়ছে দিন দিন, সে ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বক্তব্যকেই অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

এ অঞ্চলে অর্থাৎ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে, তা আমাদের এখানে কম আলোচিত হলেও, তারা কিন্তু গুরুত্ব দিয়েই দেখতে চায়। এ অঞ্চলে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানের পরেই আমরা জনসংখ্যায় এগিয়ে আছি। জনসংখ্যা একটি সম্পদ। আবার আমাদের অর্থনীতি এখন বর্ধিষ্ণু। এটাও বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখার কারণ। এই অর্থনীতির চালকের আসনে রয়েছে সাধারণ মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকে আমরা ধাপে ধাপে এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত। এসব বাংলাদেশি কর্মী তাদের অর্থনীতিকে সহায়তা করে। এটাকেও তারা মূল্যায়ন করে। একইভাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা রয়েছে, সেটার মূল্যায়নও তারা দেখতে চায়। তারা দেখতে পাচ্ছে– আগামীতে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে। আর এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, এখানে বিনিয়োগের সুযোগ হবে। এভাবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একটি বহুমাত্রিক জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে চলেছে। যেমন বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার ছাত্রছাত্রী শিক্ষা গ্রহণের জন্য যাবে। এভাবে তারা দেখতে পাচ্ছে যে, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি শক্ত অবস্থানে যাবে।

আবার যদি ভৌগোলিক দিক থেকে দেখি, তাহলেও বাংলাদেশকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেখতে পাই। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে এ অঞ্চলে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার সমূহ কারণ তৈরি হতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে দেখতে চাইছে, সবকিছু উন্মুক্ত রীতিতে– সেটার জন্যও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক যে প্রেক্ষাপট আছে, আবার জলবায়ুবিষয়ক যে বাস্তবতা সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়াস হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান।

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরকালে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া - সংগৃহীত

এবার আলোচনা করা যেতে পারে উজরা জেয়ার এই সফর ঘিরে আমাদের দেশে যে আলোচনা হচ্ছে তা নিয়ে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা কাজ করছে; বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারে কে থাকবে, কে থাকবে না– এসব নিয়ে আলোচনা। সব আলোচনাতেই দেখা যায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দুটি দল তাদের নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। এরই মধ্যে মার্কিন প্রতিনিধি দল এখানে এসে প্রধানমন্ত্রী, কয়েকজন মন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে। এই আলাপ-আলোচনার পরে তারা তাদের বক্তব্য জানিয়েছে। তারা সফর সম্পন্ন করে চলে যাওয়ার পর ঢাকার মার্কিন দূতাবাস একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। তাতে তাদের অবস্থান আমরা আরও বিশদ জানতে পেরেছি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা তাদের বক্তব্যকে নিজেদের জায়গা থেকে ব্যাখ্যা করছেন এবং বক্তব্য দিচ্ছেন। আমি মনে করি, সব দলেরই রাজনীতি আছে, নিজস্ব এজেন্ডা আছে, নিজস্ব কর্মী বাহিনী আছে। তাদের চাঙ্গা রাখতে হবে। তারা সেই আলোকেই ব্যাখ্যা করছে। বাস্তবতা যা-ই হোক না কেন, তারা তাদের মতো করেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে।

আমার কাছে যেটি মনে হয়– এর আগে ডোনাল্ড লু, শোলে থেকে শুরু করে সবশেষ উজরা জেয়া যা-ই বলুন না কেন, তাতে তাদের মূল বক্তব্যের কোনো বদল ঘটেনি। তারা সবাই বলছেন, এখানে সবার অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চান। উজরা জেয়ার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে ইউএনবিতে। চলে যাওয়ার পর প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন– ‘আমি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই। আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিই।’

এই কথার মর্মার্থ– গণতন্ত্রের মূল যে কথা অর্থাৎ নির্বাচনে জনসাধারণের সম্পৃক্তকরণ নিশ্চিত করতে হবে; নির্বাচন সম্মতিসূচক ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। এর বাইরে এখন আমাদের এখানে উজরা জেয়ার বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা অপ্রয়োজনীয় ও অদরকারি হিসেবেই দেখতে হবে। গণতন্ত্রের মৌলিক যে ভিত্তি সেটি আগে নিশ্চিত করতে হবে। সেটির কথাই বলা হচ্ছে।

একটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এখানে সংযুক্ত; গণতন্ত্র বলতে তারা যা বোঝে, বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের যে চর্চা, সেটিকেই তারা এখানে দেখতে চায়। আমরা কীভাবে গণতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করতে চাই, সেটি তারা শুনতে চায় না। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান– যারাই আমাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত, তারা যেভাবে গণতন্ত্রকে দেখতে চাইবে, সেটিকে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। এটিই হচ্ছে বাস্তবতা।

এম. হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

আরও পড়ুন

×