দ্রব্যমূল্য
চালের বাজার সামলাতে করণীয়

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০
এ সময়ে চাল আমদানি ব্যয় বেড়েছে। সেটিও বাজারে প্রভাব রেখেছে, বলা যায়। এরই মধ্যে চাল রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞায় বাজারে নতুন করে প্রভাব পড়ার ভয় রয়েছে। উৎপাদন ভালো হলেও বাজারের স্বার্থে বাংলাদেশকে প্রতিবছর কমবেশি চাল আমদানি করতে হয়। এর সিংহভাগই জোগান দেয় প্রতিবেশী দেশটি। ভারতের নিষেধাজ্ঞার খবরে ইতোমধ্যে দেশের মিল মালিক ও বড় ব্যবসায়ীর কেউ কেউ বেশি লাভের সুযোগ খুঁজছেন বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার চুক্তির মাধ্যমে যে গম রপ্তানি হতো; ‘গ্রেইন ডিল’ নামক সেই চুক্তি নবায়ন না হওয়ায় ইউক্রেন থেকে গমের আমদানি বন্ধ। ফলে চাল এবং গম উভয়ের আমদানি কমার লক্ষণ স্পষ্ট। এ অবস্থায় সরকারের উচিত হবে চালের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যেন কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। গ্যাস সংকটের কারণে সারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সারের এই ঘাটতি যে কোনোভাবে হোক পূরণ করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের চালের বাজারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা স্পষ্ট। অথচ এবার বোরো ধানের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হয়েছে। ইতোপূর্বে আমনের উৎপাদনও ভালো হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যথেষ্ট ভালো। তবুও বাজারে এ সময়ে চালের উচ্চমূল্যই দেখা যাচ্ছে। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মোটা চালের মূল্য ছিল ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। এর আগেও তার মূল্য ছিল ৪৮-৫০ টাকা। যদিও অন্যান্য বছর এ সময়ে এর চেয়ে কম মূল্যে চাল কেনা যেত।
দেশে চালের উৎপাদন সন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও বাজার কেন অস্থিতিশীল? এর কয়েকটা কারণ স্পষ্ট। চাল এবং গম বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো একে অপরের পরিপূরক। গমের সরবরাহ কমে গেলে আটার মূল্য বেড়ে যায়; মানুষ তখন চালের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। আবার চালের মূল্য বাড়লে আটায় ঝোঁকার প্রবণতাও রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন ইউক্রেন থেকে গমের সরবরাহ কমে যায় তখন অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের মূল্য বেড়ে যায়। সরবরাহে অনিশ্চয়তা এবং অন্যান্য দেশে গমের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে বাংলাদেশ সংকটে পড়ে। গমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রায় সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর। একই সঙ্গে যখন ডলারের সংকট দেখা দেয়, অর্থাৎ টাকার মূল্য কমে যায়, তখনও গমের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এ অবস্থায় চালের বাজারের ওপর চাপ বেড়েছে বলে আমাদের ধারণা। স্বাভাবিক সরবরাহ দিয়ে এই বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে চালের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
তবে এটা বলা দরকার, এ সময়ে প্রায় সব খাদ্যদ্রব্যেরই উচ্চমূল্য দেখা গেছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা মূল্যস্ফীতি দেখেছি। এ সময়ে মানুষ তুলনামূলকভাবে কম মূল্যের পণ্য দিয়ে জীবন নির্বাহ করেছে। মানুষ আমিষ থেকে সরে শাকসবজিতে গিয়েছে। কিংবা কেউ শাকসবজি থেকে সরে গিয়ে শর্করায় নেমে এসেছে। এর কারণেও অনেক ক্ষেত্রে অনুমান করা যায়, চালের ভোগ বেড়েছে।
এ সময়ে চালের চাহিদার কারণে দাম বেড়েছে। এর মধ্যে মনে রাখতে হবে, এ সময়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা মেটানোর জন্য চালের আমদানিও হয়েছে। গমের ঘাটতি এবং চালের চাহিদার উল্লম্ফনের কারণে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কিছু বেগ পেতে হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশের চালের বাজার; সে চাল আমদানি করা হোক কিংবা অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত– চালের বড় ব্যবসায়ী অর্থাৎ রাইস মিলারদের একটা প্রভাব রয়েছে এবং বড় আকারে ধান উৎপাদনকারী যারা রয়েছে, বাজারে তাদেরও একটা প্রভাব রয়েছে বলে মনে করি। এই অলিখিত প্রভাব থেকে তারা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিলে খুচরা পর্যায়ে মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে।
আমাদের দেশে অন্যান্য পণ্যের মতো চালের সাপ্লাই চেইন এখনও আনুষ্ঠানিক নয়। এ কারণে এই সাপ্লাই চেইনে কারা বাজারে পণ্য ছাড়ছেন, কারা মজুত করছেন কিংবা বাজারে কত মূল্যে তারা বিক্রি করছেন এসব তথ্যউপাত্ত সরকারের পক্ষে জানা কষ্টকর। ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক সাপ্লাই চেইনের কারণে এ ধরনের বাজার তদারকি অসম্ভব হয়ে যায়। এই দুর্বলতার কারণে বাজারে মূল্য বৃদ্ধির ঘটনা ঘটে। অনেক সময় এটা বলা হয়ে থাকে, এ ধরনের ব্যবসায়ী সামগ্রিক বাজারের সাপ্লাই চেইনের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ধান-চালের মতো বাজারে যার ১ শতাংশ হিস্যা রয়েছে, তিনি এই ১ শতাংশ কমিয়ে বাড়িয়েও বাজারে প্রভাব তৈরি করতে পারেন। আমরা আগে দেখেছি, সাপ্লাই চেইনে থাকা ব্যবসায়ীরা, বাজারে তাদের অংশ যা-ই হোক, চালের মূল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
বাজার স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকার কোনো দেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় কোনোভাবেই শিথিলতা কাম্য নয়। আমাদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিগুলোও মাথায় রাখতে হবে। ভবিষ্যতে অন্যান্য দেশও যদি রপ্তানি বন্ধ করে দেয় কিংবা কোনো দুর্যোগময় পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
- বিষয় :
- দ্রব্যমূল্য
- খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম