সরেজমিন
উত্তেজিত রাজধানীর দুটি সমাবেশ

এহ্সান মাহমুদ
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ | ০৮:৩২
শুক্রবার ঢাকার আকাশের অবস্থা ভালো করে খেয়াল করলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও কিছুটা আন্দাজ করা যেত বৈকি! রোদ, বৃষ্টি, মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি দিনভর বেশ রহস্যময় আচরণ করেছে।
ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন দুপুর ১টা ৫০ মিনিট। ঢাকার সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে তোপখানা রোড ধরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। গন্তব্য বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট– আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম তিন সংগঠনের ‘শান্তি সমাবেশ’। সেগুনবাগিচার ‘চিটাগাং হোটেল’-এর সামনে আসতেই থামতে হলো। জটলা পাকানো লোকজন একটি বড় আকারের মাইক্রোবাস ঘিরে লাইনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সবার মাথায় কমলা রঙের ক্যাপ। কাছে গিয়ে জানা গেল, এরা সবাই চাঁদপুর থেকে এসেছেন; যোগ দেবেন বিএনপির নয়াপল্টনের এক দফার মহাসমাবেশে। অল্প সময়েই দেখা গেল লাইনের গোড়ার দিকে যারা রয়েছেন, তারা খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে ফিরছেন।
আলী আক্কাস নামে একজনের সঙ্গে কথা হলো; বললেন, এলাকা (চাঁদপুর) থেকে যারা এসেছেন, তাদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা। একটি অংশ জুমার নামাজের জন্য মসজিদে, অন্যরা এখানে। সবাই ফিরলে একত্রে সমাবেশের দিকে রওনা দেবেন।
চাঁদপুরের বিএনপি কর্মী আলী আক্কাসের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটি রিকশা পাওয়া গেল পল্টন যাওয়ার জন্য। কিন্তু বিজয়নগর সেন্ট্রাল ল কলেজের পাশের গলিতে আসার পর আর সামনে এগোনো গেল না। কাকরাইলের নাইটিংগেল মোড় থেকে বিজয়নগরের প্রশস্ত সড়ক; পুরোটা বিএনপির নেতাকর্মীতে ঠাসা। অগত্যা রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করি। পুরানা পল্টন মোড়ে যাওয়ার পথে বিজয়নগরের রাস্তার পাশে দেখা গেল লেবার পার্টি, এনডিপি এবং ১২ দলীয় জোটের কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী মাইক টানিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু এসব মাইকের ওপরে বিএনপির সমাবেশের মাইক থাকায় তাদের বক্তব্য ঠিকঠাক কানে গেল না। বিজয়নগরের পথে পথে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিএনপি নেতাকর্মীর মিছিল এবং স্লোগান পাশ কাটিয়ে কোনো রকমে কায়দা করে পুরানা পল্টন মোড়ে এসে দাঁড়াই।
পল্টন মোড়ে মেট্রোরেলের জন্য নির্মিত উড়াল সড়কের নিচে সড়ক বিভাজকের জায়গায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ সটান দাঁড়ানো। যেন এখনই প্যারেড শুরু হবে। এক কর্তা পুলিশ সদস্যদের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা নির্দেশনা দিচ্ছেন। এগোতে থাকি আওয়ামী লীগের সমাবেশ মঞ্চের দিকে। জিপিওর সামনে পর্যন্ত তখনও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মানুষ জটলা করার চেষ্টা করছে। এখানেই কথা হলো মজিবর রহমানের (৪৮) সঙ্গে। তিনি এসেছেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে। জানালেন, তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক। মোহাম্মদপুর থেকে এসেছেন আরও কয়েকজনের সঙ্গে। কীভাবে এসেছেন; হেঁটে কিনা– বলতেই অবাক হয়ে বললেন, ‘হাঁইটা আসবো ক্যান ভাই! আপনারা সাংবাদিকরা খালি উল্টাপাল্টা কথা বলেন। আসছি পিকআপ ভাড়া কইরা। আরও মানুষ আছে না আমাদের!’ কিছুটা সামলে নিয়ে বললাম, আপনার সঙ্গের অন্যরা কোথায়? জানালেন, কয়েকজন নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। অন্যরা স্টেডিয়ামের দিকে খাবারের প্যাকেট আনতে গেছেন।
জিপিওর সামনে দাঁড়িয়ে সচিবালয়ের দিকে একবার তাকালাম। বন্ধের দিন। বন্ধ গেটের সামনে পুলিশ প্রহরা। জিরো পয়েন্ট, সচিবালয় হয়ে ওসমানী মিলনায়তন হয়ে যে রাস্তাটি চলে গেছে, সেটিতে অন্যান্য দিনের মতো যান চলাচল না থাকলেও মাঝেমধ্যে দুয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি, পুলিশের গাড়ি এবং যাত্রীবাহী বাসও দেখা গেল কয়েকটা। বাঁ দিকে ঘুরে তাকালেই চোখে পড়ল শান্তি সমাবেশের জন্য বেশ পরিপাটি করে তৈরি করা মঞ্চ। মঞ্চ থেকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নেতাকর্মীর ব্যানার নামিয়ে ফেলার ঘোষণা দিতে শোনা গেল বেশ কয়েকবার। এখানেই কথা হলো নুরুল ইসলাম নামে একজনের সঙ্গে। গাজীপুরের পুবাইল থেকে আসা নুরুল ইসলাম বললেন, এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। এবার পদ পাবেন কমিটিতে। নুরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলাম, আওয়ামী লীগের সমাবেশে লোকজন কেমন হয়েছে বলে মনে করেন? নুরুল ইসলাম বললেন, ‘এখনও লোকজন আইসা সারতে পারে নাই। নামাজের পর বুঝা যাবে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চলে আসলে, আশপাশে যারা আছে সবাই মঞ্চের সামনে আইসা বসবে।’
নুরুল ইসলামের কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে পল্টন মোড়ের দিকে রওনা হলাম, তখন আওয়ামী লীগের সমাবেশের মঞ্চ থেকে একটি ঘোষণায় জানা গেল– দলটির নেতৃস্থানীয় সবাই এখনও সমাবেশ মঞ্চে উপস্থিত হননি। এরই মাঝে আরেকটি ঘোষণা এলো: আওয়ামী লীগের উন্নয়ন নিয়ে সংগীত পরিবেশন করবেন দেলোয়ার হোসেন বয়াতি। দেলোয়ার হোসেন বয়াতি যখন উন্নয়নের গানের সুরে টান লাগালেন, ততক্ষণে পল্টন মোড়ে চলে এসেছি।
ফিরতি পথে পল্টন মোড়ের দৃশ্য নতুন মনে হলো। মোড়ে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের দেখা গেল কাঁটাতারের ব্যারিকেড নিয়ে ব্যস্ত। এক পুলিশ সদস্যের কাছে জানতে চাইলাম– এখানে ব্যারিকেড বসাচ্ছেন কেন? পুলিশ সদস্য কোনো জবাব দিলেন না। পাশে দাঁড়ানো আরেক পুলিশ দেখে বড় কর্তা মনে হলো; তিনি বললেন, তেমন কিছু না। বিএনপির ওদিকের লোকজন মিছিল সহকারে এই জায়গাটি দিয়ে চক্কর দিচ্ছে একটু পরপর। এখনও সবকিছু স্বাভাবিকই আছে। কিন্তু সতর্কতা হিসেবে এখানে ব্যারিকেড বসাচ্ছি, যাতে সেদিকের কেউ মিছিল নিয়ে এ পাশে না এসে পড়ে!
হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল এক মধ্যবয়সী নারীর। নাম কোহিনুর বেগম। ঝালকাঠি থেকে এসেছেন। পান চিবুতে চিবুতে জানালেন, তিনি স্থানীয় বিএনপির সাংগঠনিক পদে আছেন। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন নারী এসেছেন। কথা শেষ না হতেই সামনে থেকে একজনের আওয়াজ– ‘ও কোহিনুর বু, এদিকে আহো। পানি পাইছি।’ কোহিনুর বেগম আর কথা বললেন না। সামনে এগিয়ে গেলেন। তখন বিএনপির মঞ্চের মাইকের শব্দ বেশ স্পষ্ট পাওয়া গেল। মঞ্চে বক্তব্য দিচ্ছেন মহিলা দলের নেত্রী আফরোজা আব্বাস। এই বিএনপি নেত্রী রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতা থেকে পাঠ করছেন– ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই– ছোটো সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’ তিনি বললেন, ‘আজকে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকলে দেখতে পারতেন, এখানে তাঁর সোনার ধানে চারদিক ভরপুর।’ এমন কাব্যমাখা কথা শোনার পরে চারদিকে একবারে হইহই পড়ে গেল।
এদিক থেকে সামনে এগিয়ে নয়াপল্টনের বিএনপির সমাবেশ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু বেশিদূর এগোনো গেল না মানুষের ভিড়ে। এরই মধ্যে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। কোনো রকম দৌড়ে বিজয়নগর হোটেলের নিচতলায় আশ্রয় নিলাম। মঞ্চ থেকে শোনা গেল, কোনো এক বিএনপি নেতা বলছেন– বন্ধুগণ, এই বৃষ্টি হচ্ছে রহমতের বৃষ্টি। বৃষ্টি নিয়ে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে ‘মোটিভেশনাল’ বক্তব্য। হোটেলের ব্যালকনি দিয়ে যতদূর চোখ যায়– বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে জিন্দাবাদ স্লোগানে মুখর হয়ে গেল চারদিক। বৃষ্টি এবং স্লোগানের আশ্চর্য সুরে সবকিছু ভেসে গেল! বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে রাস্তায় নেমে এলাম। স্কাউট ভবনের সামনে দেখা গেল কয়েকজন তরুণের হাতে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নির্বাচনী এলাকা কক্সবাজারের পেকুয়া থেকে এসেছেন তারা। পেকুয়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা পরিচয়ে আহসান উল্লাহ নামে একজন বললেন, আজকের সমাবেশে তারা সালাহউদ্দিন আহমেদের পক্ষ থেকে হাজির হয়েছেন। দীর্ঘদিন ভারতে আটক এবং পরে মুক্ত হলেও এখনও তিনি দেশে ফেরেননি। চিকিৎসা শেষে নেতা দেশে ফিরবেন– এমন আশাবাদ জানালেন তারা। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, সমাবেশে কত লাখ মানুষ হয়েছে বলে ধারণা? একজন বললেন, আমার মনে হয়, কুড়ি-পঁচিশ লাখের কম না। বললাম, কুড়ি-পঁচিশে তো পাঁচ লাখের ব্যবধান থাকে। সঠিক ধারণা আছে কিনা? এবার পাশের আরেকজন বললেন, ‘কুড়ি-বাইশ লাখ হবে; শিউর।’
মানুষের উপস্থিতিতে পুরো এলাকা স্লোগানমুখর। মঞ্চে কখন কোন নেতা বক্তব্য দিচ্ছেন; মঞ্চ থেকে বহুদূরে থাকা তৃণমূলের এই কর্মী-সমর্থকরা তাঁর দিকে খেয়াল করছেন বলে মনে হলো না। সবাই নিজের মতো স্লোগান দিচ্ছেন। সবার মুখে একটাই কথা, দফা এক দাবি এক– প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ।
সমাবেশের শেষ দিকে বিএনপি মহাসচিব তাঁর বক্তব্যের মাঝামাঝি বলে উঠলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী, প্রিয় উপস্থিত বন্ধুগণ, আপনাদের জন্য আজকে একটি চমক আছে। এখন আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান।’ আমার পাশে বসে ছিলেন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। আরেক পাশে খানিক দূরে আরও কয়েকজন সাংবাদিক সহকর্মী। সবার চোখে-মুখে অবিশ্বাস! চারদিকে উল্লাস! চিৎকার! এরই মাঝে একটি কণ্ঠ শোনা গেল– ‘প্রিয় বাংলাদেশবাসী ... আসসালামু আলাইকুম।’ মুহূর্তেই চারদিকের জনতার মধ্যে যেন কী একটা ঘটে গেল! সবাই দুই হাত তুলল। শূন্যে লাফ দিল কেউ কেউ; কেউ কেউ পাশে দাঁড়ানো আরেকজনকে জড়িয়ে ধরল! এ এক অভাবনীয় দৃশ্য! এরই মাঝে দেখলাম এক বয়স্ক লোক পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছছেন। কী ব্যাপার! তিনি চোখ মুছলেন কেন? কাঁদছেন কেন? এগিয়ে যেতেই দেখা গেল সামনের পাটির দাঁত পড়ে যাওয়া বৃদ্ধ ‘তারেক রহমান’ নাম উচ্চারণ করছেন আর নিজের চোখ মুছছেন। এমন পরিস্থিতিতে কারও সঙ্গে কথা বলা যায় না। সরে দাঁড়ালাম। তারেক রহমান তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। নতুন বাংলাদেশে দেশবাসীর সঙ্গে দেখা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। সমাবেশ শেষ হওয়ার আগে ভিড়ের মধ্যে যাতে পড়তে না হয়, দ্রুত বের হয়ে চলে আসি। ততক্ষণে পেছনে মিছিলের আওয়াজ বেড়েই চলেছে। এই যে রাজধানী ঢাকা বহুকাল পরে মিছিলের নগরী হয়ে উঠল– এর সাক্ষী হয়ে রইল গোটা দেশ।
এহ্সান মাহমুদ: সমকালের সহসম্পাদক
- বিষয় :
- সরেজমিন
- এহ্সান মাহমুদ