ইউরোপের চিঠি
বয়স, উদ্বাস্তু, দাদাগিরি, নাভিশ্বাস

দাউদ হায়দার
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০
পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই সঞ্জীবের (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ) আর্তনাদ: ‘এক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি।’ সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ গল্পে বুড়োর বয়স বাড়ে না। উচ্চতাও বাড়ে না। জন্ম থেকে একই মাপের। ফিতেয় লেখা সাঁইত্রিশ। ওই দিয়েই মাপামাপি।
একালে আকছারই ৮০ পার করছেন অনেকে। এবং দিব্যি জোয়ান। সৌম্যও। মন-মননে তরুণ। তারুণিক তেজে বলীয়ান। জুন মাসে দুটি খবর বিশ্বজুড়ে। হলিউডের অভিনেতা আল পাচিনো ৮৭ বছরে বাপ হয়েছেন (স্ত্রীর বয়স ৩১)। রবাট ডি নিরোর ৮৬, স্ত্রী হাঁটুর নিচে বয়েসী। নিরোও এখন নবজাতকের ড্যাডি।
– বলতেই হয়, যৌবন সরসী নীরে।
আসল কথা চিত্তের জাগরণ, মত্ততা। কীভাবে জাগরণ, জাগরণের মাত্রা ও প্রসারে কে কতটা জাগ্রত; তলিয়ে দেখার দায় বর্তেছে ইউরোপের নানা দেশের সরকারের। মাস দেড়েক আগে ফরাসি সরকার গোঁ ধরল, আইন করবে– চাকরিজীবী ৬৫ বছর বয়সে অবসর নেবেন। সংসদে প্রস্তাবের আগেই জনগণের ফোঁস ফোঁস, অতঃপর পথেঘাটে তুমুল বিক্ষোভ। একনাগাড়ে কয়েক দিন। উপায়ান্তর না দেখে মুলতবি। কর্মীদের সাফ কথা: ‘যৌবন যায় যৌবনজ্বালা যে যায় না’, ফুর্তিফার্তা করবো না? পার্কে, রাস্তাঘাটের কাকচড়াইকবুতরকে খাওয়াবো, খুদকুঁড়ো ছিটোবো?
রাতে তারা গুনবো?’ বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে (খবরে) একজন বিক্ষোভকারীর ইন্টারভিউ শুনেছি। ‘ছোকরার খায়েশ হয়েছে আবার প্রেসিডেন্ট হবে।’ (‘দ্যাটস ইয়াংম্যান।’ ইমানুয়েল মাখোঁ)।
খুব দোষ কি ছোকরার? না। পৃথিবীর চতুর্থ ধনী দেশ জার্মানি। গোটা ইউরোপে পয়লা। বছর কয়েক আগে চাকরির সময়সীমা করেছেন ৬৫ বছর। তাল তুলেছেন ৬৭ করবেন। বসে নেই নরওয়ে। আরও এক কাঠি সরেস। ৭০ করার মতলব। ইতোমধ্যে সরকারের গুনগুনানি। বাকি নেই নর্ডিক (সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড) দেশগুলো। বুড়োরা মরছে না। এবং কর্মঠ। তরতাজা।
মূল কারণ লেবার (শ্রমিক) সংকট। দক্ষ শ্রমিকের অভাব। বিদেশ থেকে জোয়ান শ্রমিক আনবে, সমস্যাও বিস্তর। স্কিলড শ্রমিকের অভাব। আনলেও প্রশিক্ষণে সময় ব্যয়। প্রশিক্ষণের জন্যে বেতন। এও বাহ্য। গোটা ইউরোপে বিদেশি বিদ্বেষ দ্রুত বাড়ছে। দক্ষিণপন্থিরা ভোটে জিতছে। জার্মানির একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন। সুইডেনে দখলদারি। জার্মানির বিরোধী দল সিডিইউর (ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সিডিইউ বেশি পর্বে ক্ষমতায়। চলতি বছরে বার্লিন নির্বাচনে জয়ী) নেতা চরম দক্ষিণপন্থি আএফডে (অলটারনেটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড)-কে সঙ্গী করতে অরাজি নন।
উল্লেখ্য, জার্মান পার্লামেন্টের আএফডে তৃতীয় দল। এবং দাপুটে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে অধিকাংশ শ্রমিকই উদ্বাস্তু। ঠাঁই নিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়ায়। বাকি দেশগুলো অর্থনীতিতে জোরালো নয়। তো, প্রচণ্ড চাপ। কিন্তু কাজ কোথায়? না থাকলেও, ঠাঁই যখন দিয়েছে, খাওয়াতে হয়; আর্থিক সাহায্য দিতে হয়। অনেকের গোটা পরিবারকে। ‘স্কিলড’ শ্রমিকও বেকার।
ঘটনা আরও। কেন বিদেশি বিদ্বেষ বাড়ন্ত? উদ্বাস্তুরা ইউরোপীয় কালচার দূষিত করছে– অভিযোগ। সবটা মিথ্যে নয়। আইন অমান্য। বেলেল্লাপনা। চুরিচামারি। ধর্ষণ। প্রেমের নামে প্রেমিকাকে অন্তঃসত্ত্বা (প্রেমিকা কি স্বেচ্ছাকৃত নয়?)। প্রেমিক সটকে পড়ে। কেন? কয়: ‘বিয়ের আগেই এ দেশের মেয়েরা...।’ তারপর? প্রেমিক বিয়ে করে স্বদেশি। ভূরিভূরি প্রমাণ। বাদ নেই বহু ভারতীয়। বাংলাদেশি।
কালচারাল দূষণ ভয়াবহ। যে কোনো দেশে। ইদানীং বাংলাদেশেও। মোল্লাদল ফতোয়া দিচ্ছে– পয়লা বৈশাখ/নববর্ষ ইসলামিক নয়। তার মানে, বাংলার ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতি নয়। ঐতিহ্য/সংস্কৃতি কী? ‘নওরোজ’ (নওবুছ-তুরস্কে/ইরাকে/আরবের অন্যান্য ইসলামী দেশে) মহাসমারোহে, হই-হুল্লোড়ে, নাচে-গানে নওরোজ (নববর্ষ) উদযাপন কেন?
ইস্তাম্বুলে আলবেনিয়ায় দেখেছি নওরোজে সুন্দরীদের বেলি ড্যান্স। মোল্লাদের আপত্তি নেই। মোল্লারা দর্শক। হাততালি দিয়ে বাহবা।
বলছিলুম উদ্বাস্তুর কথা। বলা হয়নি ইউক্রেনের উদ্বাস্তুর। ইউক্রেনের জোকার (কমেডিয়ান) প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তালেগোলে প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেনের পূর্ববর্তী নেতা/প্রেসিডেন্ট অধিকাংশই দুর্নীতিগ্রস্ত। বীতশ্রদ্ধ হয়ে জেলেনস্কিকে ফাজলামোচ্ছলে ভোট দিয়েছেন। ভোটাররা ভাবেননি, জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট হবেন। হয়েছেন। জেলেনস্কিকে বার্লিনে দেখেছি, সংবাদ সম্মেলনে। জোকারি কথা, সাংবাদিকদের প্রশ্নে।
জেলেনস্কি রাষ্ট্রনেতা, অকুতোভয়। আমেরিকার প্রস্তাব সত্ত্বেও দেশ ছেড়ে যাননি। লড়ে যাচ্ছেন। দাদার দাদা, আমেরিকা। দাদার নির্দেশে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো থেকে সমরাস্ত্র, আর্থিক সাহায্য পাচ্ছে অঢেল। ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে এখন ধনী। সমরাস্ত্রেও।
‘কিন্তু’ আছে। ইউক্রেন থেকে যে ঢল ইইউর কযেকটি দেশে, উদ্বাস্তুরা ফিরতে চায় না। ফিরবেও না। তখন?
হল্যান্ডে দেখলুম সমুদ্রসংলগ্ন নদীতে বড় বড় জাহাজে ইউক্রেনিয়ান, তুমুল হুল্লোড়ে। অনেকেই দেহবৃত্তিতে। ট্যাক্স দেয় না।
ইউক্রেন নিয়ে ন্যাটোভুক্ত ইউরোপ সমস্যায়। কিন্তু মস্তান আমেরিকার সাগরেদ। ট্যাঁ-ফুঁ করার সাহস নেই। মেরুদণ্ডহীন। সর্বক্ষণে বৃদ্ধ। সঞ্জীব একা নন।
দাউদ হায়দার: কবি
- বিষয় :
- বয়স
- উদ্বাস্তু
- দাদাগিরি
- নাভিশ্বাস
- দাউদ হায়দার
- ইউরোপের চিঠি