ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

গৃহযুদ্ধ

মিয়ানমারে জান্তার শেষ রক্ষা হবে কি?

মিয়ানমারে জান্তার শেষ রক্ষা হবে কি?

সংগৃহীত

সেবাস্তিয়ান স্ট্র্যাজিও

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা দেশটিতে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে জান্তা সরকার আবারও নির্বাচন বিলম্বিত করছে। এর আগে সামরিক সরকার এ বছরের শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সোমবার রাজধানী নেপিদোতে দেশটির জান্তা সরকারের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিলের (এনডিএসসি) এক বৈঠক বসে। সেখানেই তারা জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

এনডিএসসির ঘোষণার বিস্তারিত প্রকাশ হয় মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারে। সেখানে বলা হয়, কয়েকটি কারণে মিয়ানমারের নির্বাচন স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারা ‘নিরাপত্তা’র বিষয়টি যেমন গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছে, তেমনি সামরিক শাসন প্রত্যাখ্যান করে সরকারের বিরুদ্ধে ‘ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ পরিচালনার ছুতোও হাজির করেছে।

সামরিক জান্তার ঘোষণায় এও বলা হয়েছে, আগামী ছয় মাসে সামরিক প্রশাসন নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতে সব পদক্ষেপ নেবে, যাতে নাগরিকরা কোনো ধরনের ভয়-শঙ্কা ছাড়াই যথাযথ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে। দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারে একই সঙ্গে জেনারেল শো উইনের বক্তব্যও প্রকাশ পায়। সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান শো উইন গুরুত্ব দিয়ে বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমাতে সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালনায় সেনাবাহিনীর কিছু সময় প্রয়োজন। তাদের এসব কর্মতৎপরতার মাধ্যমে দেশজুড়ে স্থায়ী শান্তি আসবে। কিন্তু নির্ধারিত এ সময়ের মধ্যে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির নিশ্চয়তা কী? এ সময়ের মধ্যে কথিত ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ হবে বা কমে যাবে কোন জাদুবলে?

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ২০০৮ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন করেছে, তাতে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা থাকার সুযোগ রয়েছে। জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে নতুন নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ না হলে দু’বার ছয় মাস করে এর মেয়াদ বাড়ানো যায়। সে সময়সীমা গত ৩১ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। সামরিক জান্তার এবারের পদক্ষেপ তথা আরও ছয় মাসের জন্য জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর মানে আগামী ২০২৪ সালের জুলাইয়ে নির্বাচন হবে। যদিও এই সময়সীমা নিয়েও তেমন আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সরকারপ্রধান অং সান সু চি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করার পর নিজেদের হাতে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০২০ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি-এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ওই নির্বাচন নিয়ে বেসামরিক সরকার ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে মতপার্থক্যের সূত্র ধরে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। সে সময় পরবর্তী এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে রাজধানী নেপিদো এবং প্রধান শহর ইয়াঙ্গুনে কারফিউ জারি করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত চারবার জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে এটা পরিষ্কার– দেশটির জনগণ বা অধিকাংশ এলাকার ওপর সামরিক বাহিনীর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশেষ করে মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থায় সামরিক বাহিনীর হাতে এ ক্ষমতা নেই যে তারা এমন একটি নির্বাচন করবে, যার মাধ্যমে সামরিক জান্তার বেসামরিক আদলে সামরিক শাসন কায়েমের যে খায়েশ রয়েছে, তা পূরণ হবে।

এ ঘটনা এটিও প্রমাণ করছে– সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ যে বিক্ষোভ সংঘটিত করে চলেছে, তা দমনেও জান্তা সরকার ব্যর্থ। এটা মানতেই হবে, অন্যবারের মতো এবার মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এত সহজে শাসন পরিচালনা করতে পারেনি। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকেই ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে সামরিক সরকার। মিয়ানমারজুড়ে জান্তার বিরুদ্ধে যেমন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দেখা গেছে, তেমনি সশস্ত্র প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে যে জাতীয় ঐক্য সরকার গঠিত হয়, সে ছায়া সরকারের উদ্যোগে এসব বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র দলগুলো যেমন যোগ দেয়, তেমনি বেসামরিক মিলিশিয়ারাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল; যারা পিপল’স ডিফেন্স ফোর্সেস হিসেবে পরিচিত।

জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক দপ্তর সম্প্রতি মিয়ানমার পরিস্থিতির তথ্য প্রকাশ করেছে। ১৫ জুলাই প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ লাখের এ অবস্থা হয়েছে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রায় ৭০ হাজার অবকাঠামো ধ্বংস করেছে। সামরিক বাহিনীর অভিযোগ, এসব স্থাপনার মালিক হয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে অথবা আন্দোলনকারীদের আশ্রয় দিচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে ৩ হাজার ৮০০ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে সামরিক জান্তা। অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারসের সতর্ক অনুমান, এ সময়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে।

এ অবস্থায় এমনকি সাজানো কোনো নির্বাচনের আয়োজন করাও কঠিন। সামরিক বাহিনীর পক্ষে এমন নির্বাচনও আয়োজন করা অসম্ভব, যেখানে কারচুপির মাধ্যমে তাদের পছন্দের কাউকে ক্ষমতায় বসানো যাবে। আসলে এ ধরনের কোনো বাস্তবতাই নেই সেখানে। মিয়ানমারের আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক বাহিনী বা সরকারের সংঘাতের ইতিহাস পুরোনো হলেও এখন সেটা আরও বিস্তৃত। আদিবাসী বা স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলোর সঙ্গে মিলে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে গণতন্ত্রপন্থি যোদ্ধারা। সীমান্ত বা দূরবর্তী অঞ্চলগুলো এক সময় সংঘাতপ্রবণ হলেও এখন সেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলেও। দেশের বড় এলাকায় এখন হয় প্রতিরোধ হচ্ছে কিংবা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মোট কথা, সামরিক বাহিনী এখন এমন সংঘাতের মধ্যে ব্যস্ত, যা এড়িয়ে তাদের পক্ষে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন হবে। এ পরিস্থিতির যে কবে পরিবর্তন হবে, তা কেউ বলতে পারছে না।

সু চির দল এনএলডির সাবেক আইনপ্রণেতা নে ফোন ল্যাট বর্তমানে ঐক্য সরকারের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। তিনি অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এপিকে বলেন, ‘জান্তা সরকার রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়েছে। এর কারণ সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের ক্ষমতার লোভ। তারা কোনোভাবেই ক্ষমতা হারাতে চান না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরাও বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এই সংগ্রাম আরও বেগবান করব।’

সেবাস্তিয়ান স্ট্র্যাজিও: ডিপ্লোম্যাটের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সম্পাদক; দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×