সরেজমিন
বাঙালির তীর্থস্থানে একদিন

ফাইল ছবি
অমিতোষ পাল
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৩ | ০২:২২
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার ওয়াজেদ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সদানন্দ কুমার বিশ্বাস তাঁর শিক্ষার্থীদের নিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়েছিলেন। সমাধিসৌধের পাশে দাঁড়িয়েই তিনি বললেন– ‘বাংলাদেশকে জানতে হলে বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে’। ইতিহাস জানা নতুন প্রজন্মের জন্য খুবই প্রয়োজন।
টুঙ্গিপাড়ার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ও সখ্যের গল্প। টুঙ্গিপাড়ায় নিজের বাড়ির পাশের যে ঘাট থেকে বঙ্গবন্ধু নৌকায় উঠতেন সেই হিজলতলা ঘাটে বসে কথা হয় তাঁর চাচাতো ভাই শেখ বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে। ঢাকা থেকে যখন হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় নেওয়া হয়, সেই দৃশ্যের সাক্ষীও তিনি। তিনি বলেন, হিজলতলা ঘাট থেকে কিছু দূরে গিয়েই নদীটি মিশেছে বাইগার নদীর সঙ্গে। গোপালগঞ্জ যেতে হলে বাইগার নদী হয়ে যেতে হতো। সেখান থেকে পরে স্টিমারে তিনি ঢাকা, কলকতায় যাতায়াত করতেন।
বোরহান উদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর হাতের স্পর্শ যে পেয়েছে সেই বুঝতে পারবে তার কী বিশাল হৃদয় ছিল। যেমন তাদের বাড়িতে ব্রিটিশ আমল থেকেই একজন নারী গৃহস্থালি কাজ করতেন। সবাই তাকে ‘কাঞ্চি বু’ বলে ডাকত। সে খুব পান খেত। একদিন হঠাৎ করে কাঞ্চির পা ভেঙে গেল। তখন কাঞ্চি বু কাজে আসে না। বঙ্গবন্ধু গাজী রকেটে করে বাড়িতে এসেছেন। এসেই বললেন কাঞ্চি বুকে তো দেখছি না। তিনি কাঞ্চি বুকে নিয়ে ঢাকায় গেলেন এবং পিজিতে ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা কাঞ্চির ওপর অনেক অত্যাচার করায় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু আবারও কাঞ্চিকে ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখান।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করে শেখ বোরহান উদ্দিন বলেন, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। বাড়ির পাশে একটা ওয়্যারলেস স্টেশন ছিল। একদিন সকালে হঠাৎ করে শেখ বোরহান উদ্দিনের বড় ভাই শেখ কবির ওয়্যারলেসে ফোন দিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, টুঙ্গীপাড়ার খবর কী বল? ঢাকায় সব শেষ। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বোধহয় কেউ জীবিত নেই। এর কিছুক্ষণ পরই বোরহান উদ্দিন দেখেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে কবরস্থানের জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজছেন। একবার বলে পাঁচটা আরেকবার বলে সাতটা কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করো। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা ভেবে এখনও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না বোরহান উদ্দিন।
বঙ্গবন্ধু টুঙ্গিপাড়ার মানুষের কাছে যেমন ছিলেন একান্ত আপন, তেমনই হয়ে উঠেছিলেন গোটা বাঙালি জাতির আপনজন। তিনি ছড়িয়ে গিয়েছিলেন বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করেছে। তাঁকে আদর্শিকভাবে হত্যা করতে পারেনি। বাঙালির হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই আজও প্রতিদিনই টুঙ্গিপাড়ার পুণ্যভূমি হাজারো মানুষের গন্তব্য। বঙ্গবন্ধু ছড়িয়ে যাচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বিষয়টি আরও গুছিয়ে বলেছেন। তাঁর মতে– দেশপ্রেম, কর্ম, আত্মত্যাগ, বিশাল হৃদয়, নেতৃত্বগুণসহ অনেক গুণে গুণান্বিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। যে কারণেই তিনি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন। অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নিয়ে বাঙালি জাতির পিতা হয়েছেন। তিনি নেই; কিন্তু পিতার জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া হয়ে উঠেছে বাঙালির তীর্থস্থান।
অমিতোষ পাল : সাংবাদিক
- বিষয় :
- সরেজমিন
- অমিতোষ পাল
- বাঙালির তীর্থস্থান