ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শরণার্থী

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বিলম্বের কারণ

রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে বিলম্বের কারণ

জি. এম. আরিফুজ্জামান

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০

২০১৭ সাল থেকে প্রায় অর্ধযুগ অতিক্রান্ত হলেও মিয়ানমার একজনও রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে ফেরত নেয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে নাটকীয়তার জন্ম দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলেও বরাবরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনার ওপর কুঠারের আঘাত দিয়েছে মিয়ানমার। বাংলাদেশ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর ১৯ দফা সংবলিত একটা সমঝোতা দলিল স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে। সে চুক্তির আলোকে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে সাত ভাগে বিভক্ত করে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলে মিয়ানমার।

নাগরিকতার তথ্য-প্রমাণের দোহাইয়ে চুক্তিটি আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৯ সালেই মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া, যা এখনও চলমান। সেই মামলার শুনানি চলাকালীন অং সান সু চিসহ তাদের সব আইনজীবী এবং কৌঁসুলি ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এবং তাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। অবাক হলেও সত্য, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও হয়নি মতের পরিবর্তন।

 বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কক্সবাজারের পাশাপাশি ভাসানচরে স্থাপিত হয়েছে রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্প। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের সব সুবিধা নিশ্চিতকরণের জন্য যা যা করার তাই করছে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নেই সামান্য সহযোগিতা। আন্তর্জাতিক মহলের জোরালো ভূমিকা নিয়ে আছে নানা প্রশ্ন। ২০২১ সালের ১৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত রেজুলেশনে দেশটির নানা সমস্যা বিশেষত গণতান্ত্রিক সমস্যা, জরুরি অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও জায়গা পায়নি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গোলাগুলি, নির্যাতন, মাদক পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড যেন অনেকটা নিয়মিত চিত্র ক্যাম্পগুলোতে। ক্যাম্পগুলোতে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা যেন ওপেন সিক্রেট। গণমাধ্যমের বরাতে কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য মতে, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আড়াই হাজারের বেশি মামলা আছে, যার আসামির সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। আরসা, আরএসও, নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপসহ প্রায় ১০-এর অধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কথিত আছে, এই গ্রুপগুলোর পেছনে রয়েছে মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর অদৃশ্য হাত। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ (মাস্টার মুহিবুল্লাহ) হত্যার শিকার হন। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন।

বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব বহন করছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচ এবং মিয়ানমারের উদাসীন মনোভাবের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে। এই দেরির পেছনে যে কয়েকটি কারণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো নাগরিকত্ব, স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের পরিবেশ।

১৯৮২ সালের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের বার্মা নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে বাঁধ দিয়ে দেয়। সে থেকে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমার তাদের দেশের নাগরিক মানতে নারাজ। এই প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের বিষয়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মিয়ানমার। নাগরিকত্ব আইনের বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল বরাবরই নীরব। এ পর্যন্ত দুইবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের চূড়ান্ত উদ্যোগ নিলেও সেটা ভেস্তে যায় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে আপত্তি থাকায়। ২০১৭ সালের নভেম্বরের চুক্তির আলোকে সে বছর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়। তখন মিয়ানমার তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের নামে কালক্ষেপণের রাজনীতি শুরু করে। ২০১৮ সালে প্রত্যাবর্তনের শুরুর চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ২০১৯ সালে চীনের মধ্যস্থতায় আবার প্রত্যাবর্তনের শুরুর বিষয়টি ব্যর্থ হয় রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ ফেরত উপযোগী নয় এই শঙ্কার কথা বলে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার বদলের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের আলোচনা।

তবে আশা জাগানিয়া হলো, ২০২৩ সালে এসে চীন আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনা চলমান রয়েছে। তবে, আবারও দুটি বিষয় বাদ সেধেছে এই প্রক্রিয়ায়। প্রথমটি রোহিঙ্গাদের সম্মতি এবং দ্বিতীয়টি প্রত্যাবর্তনের স্থান। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ বছরের মে মাসে রোহিঙ্গাদের একটি দল প্রথমবারের মতো রাখাইন রাজ্যে যায় বসবাস উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি আছে কিনা দেখার জন্য। গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফেরার পর সেখানকার পরিবেশ দেখে তাদের কেউ কেউ মিয়ানমারে ফিরতে রাজি, আবার কেউ কেউ রাজি নন বলে জানান। পরিবারের সব সদস্যের একসঙ্গে আদি গ্রামে ফিরে যাওয়ার দাবিও আসে। প্রাথমিক পর্যায়ে মিয়ানমারের উত্তর মংডু ও কাছাকাছি এলাকায় ক্যাম্প বা মডেল ভিলেজের কথা উঠে আসে প্রত্যাবর্তনের জন্য।

রোহিঙ্গাদের পরিবারের সব সদস্যকে একসঙ্গে নেওয়া হবে কিনা সেটা যেমন স্পষ্ট নয়, একইভাবে নিজেদের গ্রামে নেওয়া হবে নাকি মডেল ভিলেজে প্রত্যাবর্তন করা হবে সেটা নিয়ে মিয়ানমার নতুন রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। আবার, আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে এই প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়ে দাঁড়ায় কিনা সেটাও নতুনভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে, রোহিঙ্গাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি পুনর্বাসন কর্মসূচি দাঁড় করানোর পরিকল্পনা সামনে আসার পর। তবে যাই হোক, সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উচিত মানবিক দিককে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপে সহায়তা করা।   

জি. এম. আরিফুজ্জামান : সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

আরও পড়ুন

×