কূটনীতি
ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশের আর কত অপেক্ষা

মো. তৌহিদ হোসেন
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৩ | ১২:৫৩
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলো। এ সম্মেলন ঘিরে জল্পনাকল্পনা ছিল– বাংলাদেশ এবার সংস্থাটির সদস্য হতে পারবে কিনা। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সদস্য হতে পারেনি। যদিও ব্রিকস– মানে ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বাইরে এর সম্প্রসারণ এই সম্মেলনে ঘটবে কিনা, তা নিয়ে আগে থেকেই সন্দেহ ছিল। ২২ আগস্ট শুরু হওয়া এবারের সম্মেলনের আগে ২২টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আবেদন জানিয়েছিল। যোগদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল আরও ২০টি দেশ। আনুষ্ঠানিকভাবে যেসব দেশ আবেদন জানিয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশও ছিল। এদের মধ্যে আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ব্রিকস জোটের পূর্ণ সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই দেশগুলোর সদস্যপদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।
এবারের সম্মেলনে প্রথমে মনে হচ্ছিল যে, ব্রিকস সম্প্রসারণ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে না। পরে দেখা গেল, সম্প্রসারণই ব্রিকসের এবারের অন্যতম এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিকসের সব সদস্যই সম্প্রসারণের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ছয়টি দেশকে তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছে। চীন এবং রাশিয়া সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে ছিল। ভারত চেয়েছিল, একটু দেখেশুনে রয়েসয়ে সিদ্ধান্ত নিতে। মানে নীতিমালা ঠিক করে কাদের নেওয়া হবে, কবে নেওয়া হবে ইত্যাদি। এখন বাংলাদেশ সদস্য না হতে পারলেও পরবর্তী সময়ে হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, আমরা প্রথম দফার সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছি এবং ভবিষ্যতে এটি আরও হবে।
প্রশ্ন উঠছে– বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলে কী হতো। অর্থাৎ পশ্চিমাদের দিক থেকে তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিত কিনা। বলে রাখা ভালো, এই গ্রুপিংয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ চীন। চীন চাইবে সেখানে তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে। তবে ভারত সেটা নিশ্চয় পছন্দ করবে না। সে জন্য ব্রিকসে এই টানাপোড়েন থেকেই যাবে। বাংলাদেশ তো এখনও সদস্য হয়নি। যদি হতোও, তাহলে এমন হতো না যে, শুধু বাংলাদেশই ব্রিকসের সদস্য হচ্ছে, অন্য কেউ না। বাস্তবতা হলো, ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানিয়েছে ২২টি দেশ। সে জন্য আমরা একেবারে এক দিকে ঝুঁকে গেছি– এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হতো না। ফলে এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলেও এর কারণে এমন কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না যে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যেসব সম্পর্ক রয়েছে, তাতে সমস্যা হবে। কারণ ব্রিকস এমন কোনো সংগঠন এখনও হয়ে উঠতে পারেনি, যা পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। হয়তো ব্রিকসের সদস্য হলে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে আমাদের কিছু সুবিধা হতে পারে। তবে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের বেশি স্বার্থ থাকবে পশ্চিমের সঙ্গেই।

ব্রিকসের সদস্য হতে না পারায় আমি তেমন ক্ষতিকর কিছু হওয়ার কোনো আশঙ্কা দেখছি না। কারণ ব্রিকস এখন পর্যন্ত যুগান্তকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কিংবা সে ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। ব্রিকসের উল্লেখ করার মতো একমাত্র সাফল্য হলো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এ ব্যাংকের সদস্য হয়েছে। গত প্রায় ১০ বছরে এ ব্যাংকটি বিভিন্ন দেশে যে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়েছে, তার চেয়েও অনেক গুণ সহযোগিতা দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফ। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফের সঙ্গে সে অর্থে তুলনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। তবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা কনসেশনাল ঋণ পেলে সেটা আমাদের জন্য উপকারী হতে পারে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের সদস্য। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানের সদস্য হয়েও আমরা যে সেখানে খুব প্রভাবশালী হয়ে গেছি, তা কিন্তু নয়। যারা শক্তিশালী দেশ তারাই প্রভাবশালী হয় যে কোনো প্রতিষ্ঠানে। ব্রিকসের বর্তমান বাস্তবতা যদি আমরা দেখি, এখানে রাশিয়া, চীন ও ভারতই মূল শক্তি হবে। আমরা এর সদস্য হলে ব্রিকসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব কিংবা তারা সব সময় যে আমাদের কথা শুনবে– এমনটি নয়। তবে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলে আমাদের একটা অ্যাভিনিউ খুলে যায়, যেখানে আমরা সমস্যার কথা বলতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কিছুতে সমর্থন দিতে বা পেতে পারি। এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে তারা ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং সে দেশগুলোর পূর্ণ সদস্যভুক্তি জানুয়ারি ২০২৪ থেকে কার্যকর হবে। ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশকে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। সেটা কত দিন– এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।
মো. তৌহিদ হোসেন: সাবেক পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অনুলিখন
- বিষয় :
- কূটনীতি
- মো. তৌহিদ হোসেন