কূটনীতি
ব্রিকস, বন্ধুত্ব ও বাংলাদেশ

মঞ্জুরে খোদা
প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৩ | ১৮:০০
গত ২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন যেভাবে বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়ে উঠেছিল, সেটা অতীতে দেখা যায়নি। কভিড পরিস্থিতির কারণে ২০১৯ সালের পর প্রথম সরাসরি অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন নানা বিবেচনায় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই সম্মেলন ঘিরে আন্তর্জাতিক নানা হিসাবনিকাশ ছিল। এ ছাড়া ব্রিকসের সম্প্রসারণও ছিল একটি বড় বিষয়। ঢাকার দিক থেকেও এ সম্মেলন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এবারই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল।
ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন, সাউথ আফ্রিকা) একটি অর্থনৈতিক জোট। যেমন জি৭, জি২০; ব্রিকস তেমনি একটি বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির জোট। এই শতাব্দীর শুরুতে এ জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে এই জোট। বিশ্ববাণিজ্যের ২৬ শতাংশ, জিডিপির ১৬ শতাংশ তাদের। বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামরিক-পারমাণবিক শক্তিতেও তাদের অবস্থান অগ্রগণ্য। বর্ধিত ব্রিকস ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব জিডিপির ৩০ শতাংশের অংশীদার হবে; বিশ্ব জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ ও ৬০ শতাংশ তেল-গ্যাস তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এবারের সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক আলোচ্য বিষয় ছিল– ১. ব্রিকসের এক্সটেনশন বা নতুন সদস্য গ্রহণ, ২. অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ৩. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ৪. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্থরতা, ৫. পারস্পরিক বিনিয়োগ সুবিধা, ৬. শক্তি বা জ্বালানি সম্পদের সহযোগিতা, ৭ ডিজিটাল ইকোনমি, ৮. কর্মসংস্থান, ৯. ডি-ডলারাইজেশন, ১০. ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন মুদ্রা প্রচলন।
এজেন্ডা অনেক থাকলেও তিন দিন এই সম্মেলনের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ব্রিকসের পরিধি কীভাবে বাড়ানো হবে তা নিয়ে। কোন দেশকে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, কোন দেশকে করা হবে না, সে আলাপে আটকে ছিল সম্মেলনের একটি বড় সময়।
জানা যায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম থেকেই এর পরিধি বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন। তাঁর ভাবনা ছিল, ব্রিকস যেন কোনোভাবেই একটি ‘অ্যান্টি ওয়েস্ট ব্লক’ হিসেবে পরিচিতি না পায়। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অনেক বিতর্কের পর তাঁকে ব্রিকসের বর্ধিতকরণের পক্ষে মত দিতে হয়েছে।
সূত্রমতে, ৪৩টি দেশ ব্রিকসের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও, ব্রিকসের সদস্য হতে ২২টি দেশ আবেদন করেছিল। এর মধ্য থেকে ৬টি দেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। যে ৬টি দেশ ব্রিকসের সদস্য হলো– সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিসর এবং ইথিওপিয়া। নতুন দেশগুলোর সদস্যপদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এ সদস্য বাছাই করা হয়েছে, তা এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
ব্রিকস তথ্যকেন্দ্র জানিয়েছে, তারা একটি নীতিমালার ভিত্তিতে এই সদস্য নির্বাচন করেছে। একই নীতিতে ভবিষ্যতেও ব্রিকসের নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে এর সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, ব্রিকস হচ্ছে ছোট-বড় অর্থনীতির গণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর একটি সম্মিলিত ব্লক।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শীর্ষ সম্মেলনে সরাসরি যোগ দেননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ তাঁর প্রতিনিধিত্ব করেন। ভার্চুয়ালি উপস্থিত হয়ে ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেছেন, ‘ডলারের বৈশ্বিক একক আধিপত্যের দিন শেষ। যদিও ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর জন্য একটি একক মুদ্রা চালুর বিষয়টি কঠিন; তবে এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আমরা সামনে এগিয়ে যাব। তিনি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে উন্নয়নের জন্য রাশিয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ব্রিকস সত্যিকার অর্থে একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গঠনের পক্ষে কাজ করছে।’
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেছেন, ‘চীন ইতিহাসের সঠিক পথেই আছে। তাদের প্রকৃতিতে (ডিএনএ) আধিপত্য বলে কিছু নেই।’
নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি এনকোসি জুইলিভেলিল ম্যান্ডেলা রুশ সংবাদমাধ্যম আরটির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্রিকস জনপ্রিয় হচ্ছে। কারণ এটি পশ্চিমা আধিপত্যবাদের বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। ব্রিকস ব্যাংক অনেক দেশের কাছে আকর্ষণীয়। কারণ এই ব্যাংক বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বিকল্প হিসেবে হাজির হয়েছে। ব্রিকস ব্যাংকের সুদের হার এসব প্রতিষ্ঠানের মতো কঠিন শর্ত ও উচ্চ হারের বিষয় নেই।
ব্রাজিল এবং আফ্রিকান দেশগুলো ভবিষ্যতে একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভা জোহানেসবার্গে ব্রিকস বিজনেস ফোরামের সঙ্গে তাঁর দেশের পুনরুত্থিত সম্পর্ককে স্বাগত জানান। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশগুলোকে ন্যায়সংগত এবং পরিবেশগত উপায়ে উন্নয়ন করতে হবে। এ কারণেই ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কেন প্রথম ধাপে ব্রিকসের সদস্যপদ অর্জন করতে পারল না? যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ এ ব্যাপারে আশাবাদী ছিল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের অনাগ্রহের কারণে নাকি বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্যপদ পায়নি। সম্ভবত ভারতের ওপর মার্কিনিদের একটা চাপ ও তাদের মধ্যে একটা কূটনৈতিক বোঝাপড়া ছিল।
শোনা যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন সদস্য গ্রহণের শর্তে বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা কোনো দেশকে ব্রিকসের সদস্য না করাই সমীচীন। একই সঙ্গে দেশটির মাথাপিছু জাতীয় আয়, উৎপাদনের বিষয়টিও সদস্যপদ অর্জনের শর্ত হিসেবে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। তাঁর এ দুই শর্ত ব্রিকস সম্প্রসারণের বিষয়কে প্রশ্নের মুখে ফেলে। বাংলাদেশ এখন যেহেতু মার্কিন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শর্তের মধ্যে আছে, অতএব তার এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের সদস্যপদ আটকে যায়। সে কারণেই বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্যপদ না পাওয়ায় ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি টুইটে লিখেছেন, ‘ব্রিকসের ১৫তম বার্ষিকীতে আমরা এই ফোরামকে সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভারত বরাবরই এ সম্প্রসারণকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে এসেছে। এ ধরনের সম্প্রসারণ ব্রিকসকে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করবে।’
লক্ষণীয়, সদস্যপদ না পেলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সম্মেলনের ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তাঁর একটি বৈঠক হয়েছে। ওদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় কোনো বৈঠক হয়নি। যদিও বিশ্বনেতাদের সম্মানে দেওয়া নৈশভোজের সময় নরেন্দ্র মোদি চেয়ার থেকে উঠে এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন।
আমাদের মনে আছে, বছর কয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি; সারাজীবন মনে রাখবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত কি তা মনে রেখেছে? অন্তত ব্রিকসে নয়াদিল্লির ভূমিকা দেখে সেটা মনে হয় না। ভারত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু সব দেশেরই নিজস্ব কৌশল ও নীতি থাকে, যেখানে নিজের দেশের স্বার্থই শেষ কথা। যে কারণে কূটনীতিতে একটি বিষয় খুব প্রচলিত– দ্বিপক্ষীয় স্বার্থে একসঙ্গে সব দিতে নেই। পরবর্তী আলোচনা ও সুবিধা আদায়ের জন্য কিছু হাতে রাখতে হয়; কিছু ইস্যু জিইয়ে রাখতে হয়। ইন্দিরা গান্ধীর একটি বিখ্যাত কূটনৈতিক দর্শন হচ্ছে ‘ঝুলিয়ে রাখার নীতি’। ব্রিকসে কি সেই নীতিরই প্রতিফলন ঘটল?
বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলে কি কোনো লাভ হতো? এটা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত-মতান্তর আছে। তবে এ কথা বলা যায়, একটি অর্থনৈতিক জোটের অংশীদার হলে জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়নে বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। বাংলাদেশ এখন অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি সংকটময় সময় পার করছে।
স্ব-উদ্যোগেই তাদের সেখান থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। সেটা হলে বৃহৎ শক্তি-জোটের কাছে আবেদন তৈরি হবে।
ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
- বিষয় :
- ব্রিকস
- বন্ধুত্ব ও বাংলাদেশ
- মঞ্জুরে খোদা
- কূটনীতি