ইউরোপের চিঠি
বার্লিনে গুণী বাঙালির আস্তানায়

দাউদ হায়দার
প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
জন্মেছিলুম কোনো এক তারিখ-মাস-সনে। পাবনার দোহারপাড়ায় থাকাকালীন শহরের স্কুলে পড়ি। গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউট, সংক্ষেপে জিসিআই। বহু বিখ্যাতজন পড়েছেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান। গত শতকের শেষ পঞ্চাশ দশকের কথা বলছি।
জানতুম– একজনেরই জন্মদিন, সেই উপলক্ষে স্কুলে ছুটি। বাকিদের জন্মদিন নেই, জন্মদিন হয় না। কে একজন? স্কুলের ড্রিল মাস্টার এবং অঙ্কেরও মাস্টার মহেন্দ্রনাথ দত্ত স্যার: ‘মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নামের আগে সম্ভ্রম সহকারে বলবে কায়েদ-ই-আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ। তিনি আমাদের পাকিস্তানের জনক, পূর্ব পাকিস্তানও তাঁহার দান।’
বাড়িতে কখনও জন্মদিনের অনুষ্ঠান দেখিনি। হয়ও না। কী করে হবে? বাপ-মায়েরই হয়তো মনে নেই। তিন মায়ের ষোল সন্তান। স্বামী একজন। বাপের তিন বিয়ে। বাপ নিশ্চয় ইচ্ছাকৃত ভুলে যান। চাঁদে-চাঁদে সন্তানের জন্মদিন কেই-বা মনে রাখে!
ঢাকায় এসে শুনলুম, নূরী আপার জন্মদিন। এসেছি ১৯৬২ সনে, প্রথম। থাকি ৩২ নম্বর বেচারাম দেউড়িতে। পাশের বাড়ির ২৩ বছর বয়স্কা নূরী আপার জন্মদিন। সন্ধ্যায় পায়েস খাওয়ার দাওয়াত।
মালিবাগে নতুন আস্তানা। ভর্তি হয়েছি সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলে। শুনলুম, কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উপলক্ষে দেয়াল পত্রিকা বেরোবে। নজরুলকে নিয়ে লেখার আহ্বান।
তাহলে একজনেরই জন্মদিন হয় না কেবল; অন্যদেরও হয়!
দেয়াল পত্রিকায় ছয় লাইনের পদ্য লিখলুম। মনোনীত। প্রকাশিত। মনে আছে প্রথম দুই লাইন– ‘নজরুল জীবনে করেছ মস্ত ভুল/ দাড়ি না-রেখে রেখেছ চুল’।
লেখার অপরাধে ক্লাসের স্যার দুই কান মলে দুই কনুইয়ে ডাস্টবিন দিয়ে পিটিয়ে নির্দেশ দিলেন: ‘স্কুলের ভিতরে গরু যাতে না ঢোকে, দেখা।’ দেখলুম, ছাগল ঢুকছে। কী করণীয়? ভুলে গেলুম।
নিজের জন্মদিন? পালন করি না। বঙ্গভাষীরা মহাউৎসবে শোক দিবস যাপন করে। জন্মেছিলুম ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সনে। একটি পদ্যে লিখেছিলুম: ‘বাংলা ভাষার সমান বয়েসী আমি।’
যিশুর জন্মের হাজার বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্বে এশিয়ার বৌদ্ধ ধর্মীয়রা গৌতম বুদ্ধের জন্মতিথি উৎসব করে। বৈশাখী পূর্ণিমা।
ইউরোপে যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন পালন প্রথম শতাব্দীর শুরু থেকে; রোমক সম্রাটের আজ্ঞায়। ধর্মীয়। সাধারণ মানুষও, ধর্মের নামে নয়। নিছকই আনন্দ, হুল্লোড়, উৎসব। ইউরোপ থেকেই ছড়িয়েছে বিশ্বের নানা দেশে। বঙ্গেও। দেড়শ বছরও হয়নি। ইংরেজের দেখাদেখি হলেও রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে। তাও রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পরে। তাও আবার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর ছত্রছায়ায়। সায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই। কবিতা লেখেন: ‘চির-নূতনেরে দিল ডাক/ পঁচিশে বৈশাখ’।
লক্ষণীয়, আমরা বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, বঙ্কিমের জন্মদিন স্মরণ করি না। মধুসূদনের জন্মদিন কোনো কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পালন করে; ছোট আকারে; দেশব্যাপী নয়। পত্রপত্রিকাও মৌনী। ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়ায় দেড়শ বছর আগেই মধুসূদন যুক্ত। বাংলা কবিতার যুগ প্রবর্তক। ভুলে যাই!
ইসলামিক মাস বা বাংলা মাসের কোন তারিখে কার জন্মদিন, মনেও রাখি না কিংবা জানি না। ইংরেজি তারিখ, মাস ঠিকই মনে রাখি। ট্র্যাডিশন এখন।
মামুন খানের জন্মদিন স্মরণীয়। ২৬ আগস্ট। জন্ম ঢাকায়, বাস বার্লিনে। ওর অগ্রজ কামরুলের সহপাঠী সিদ্ধেশ্বরী হাই স্কুলে। মামুনের বড় ভাই মনজুরুল আহসান খান রাজনীতিক। নেতা। কমিউনিজমে দীক্ষিত। মেজো ভাই বদরুল আহসা
ন খান বাচিকশিল্পী। আবৃত্তির সিডি প্রকাশিত। ইউটিউবে, ফেসবুকে সুলভ।
মামুনের জ্ঞাতিকুলে নারীনেত্রী মালেকা বেগম, কমিউনিস্ট পার্টির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম; আরও অনেকে। কমিউনিজমের তকমায় মামুন পূর্ব বার্লিনে কমিউনিস্ট আমলে উচ্চশিক্ষার্থে স্কলারশিপধারী। ভালো ছাত্র। পড়াকালীনই আন-এর মায়ায় জড়িয়ে একাত্ম। বিয়ে। আনে-মামুন দুই পুত্রের জননী-জনক। চমৎকার বাংলা বলেন আনে। নিন্দুককুলের কথা: ‘মামুনের চেয়ে আনে ভালো, শুদ্ধ বাংলা কয়।’
দেখা হলেই প্রথম প্রশ্ন: ‘সমস্ত কুশল তো?’
আনের কথায় বোঝা দুষ্কর– তিনি জার্মান, না বাঙালি? বহু বাঙালির (দুই বাংলার) বউ জার্মান। আনের মতো অন্য কারোর বউ এতটা বাংলা রপ্ত করেননি। বলেন, ‘বাংলার কালচার জানাও দুই দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে সহায়ক।’
ভুলছি না বারবারা দাশগুপ্তকে। সুনীল দাশগুপ্তর স্ত্রী। অনুবাদ করেছেন হাসান আজিজুল হকের গল্প, আবুল হাসানের কবিতা। রবীন্দ্রনাথও। তাঁর অনুবাদ বহুল প্রশংসিত।
বার্লিনে অনেক গুণী বাঙালির আস্তানা। ভুলছি না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের কথা। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘চাচা কাহিনী’। চাচা বার্লিনের। রেস্তোরাঁর মালিক। রেস্তোরাঁ সাভ্যিনিয়া প্লাৎস অঞ্চলে। ওখানে সুন্দরীর জমজমাট আনাগোনা। লোকে কয়, সৌন্দর্যময় তল্লাট। তা বলুক। মুজতবার তত্ত্বতালাশ কেন? যেহেতু সাহিত্যের শিল্পী বয়সঞ্চারী।বার্লিনে বহু গুণী বাঙালির বাস। মন ও মননে বাঙালি হলেও ইউরোপিয়ান। বাংলা-ইউরোপকে দ্বৈত সত্তায় একীভূত করেন। দেশ ছেড়ে দ্বৈত সত্তার এককতা। মামুনের ষাট জন্মদিনে দুই বাংলার বিস্তর গুণী। জার্মানিসহ ইউরোপের নানা দেশের। অনুষ্ঠানে বাংলা-ইউরোপের সম্মিলন, একাত্মতা। অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথেরই গান: ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায়।’
ধন্যবাদ আনে-মামুনকে। মামুন-আনে, মামুনের ৬০ জন্মদিনে বাংলা-ইউরোপকে এক আত্মায় গেঁথেছেন। গ্রন্থনে বাংলা-জার্মান সংস্কৃতির রূপ সম্মিলিত। ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো।’
দাউদ হায়দার: কবি
- বিষয় :
- ইউরোপের চিঠি
- দাউদ হায়দার